ব্রাহ্ম সমাজ

ভূমিকা

ব্রাহ্ম সমাজ উনিশ শতকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। এটি রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমাজ হিন্দুধর্মের প্রচলিত কুসংস্কার ও অসংগতি দূর করে উপনিষদের আদর্শে একটি সরল, যুক্তিবাদী এবং একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল। ব্রাহ্ম সমাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল বর্ণপ্রথা, সতীদাহ, বাল্যবিবাহ এবং জাতিভেদ প্রথার মতো সামাজিক ব্যাধিগুলির বিলোপ ঘটানো এবং সমাজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করা।

প্রতিষ্ঠা ও প্রেক্ষাপট

উনিশ শতকের ভারতবর্ষে সামাজিক ও ধর্মীয় স্থবিরতা বিরাজ করছিল। হিন্দু সমাজ কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও নানা প্রকার অপপ্রথা দ্বারা জর্জরিত ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে এবং এর ফলে সমাজের উপর পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে রাজা রামমোহন রায়, যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, আইনজীবী এবং সমাজ সংস্কারক, সমাজের এই অসংগতিগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, সমাজের উন্নতি 위해서는 ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার অত্যাবশ্যক।

রামমোহন রায় উপনিষদ, বেদান্ত এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন করে একেশ্বরবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি ঈশ্বরের একত্ব উপলব্ধি করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, উপনিষদে বর্ণিত আধ্যাত্মিক জ্ঞানই মুক্তি লাভের একমাত্র পথ। এই বিশ্বাসকে ভিত্তি করে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা করেন।

ব্রাহ্ম সমাজের প্রাথমিক পর্যায় (১৮২৮-১৮৪১)

ব্রাহ্ম সমাজের যাত্রা শুরু হয় ১৮২৮ সালের ২০শে আগস্ট, রামমোহন রায়ের ব্যক্তিগত বাসভবনে। এই সভায় সমাজের মূল উদ্দেশ্য ও নীতিগুলি আলোচনা করা হয় এবং একটি প্রাথমিক কাঠামো তৈরি করা হয়। ১৮২৯ সালে, সমাজ একটি হল ভাড়া করে এবং নিয়মিতভাবে উপাসনা ও আলোচনা সভা শুরু করে।

ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম দিকের সদস্যরা ছিলেন মূলত কলকাতার শিক্ষিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ। সমাজের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রামচন্দ্র বিদ্যবাগীশ প্রমুখ। রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মীয় ও দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য তীব্র আন্দোলন করেন এবং ১৮২৯ সালে বেনারসে গিয়ে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে এই বিষয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এর ফলস্বরূপ, সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যদের জন্য সব্যসাচী নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যেখানে ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। তিনি আর্যাবীয়, ফার্সি, সংস্কৃত, ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে তত্ত্ববোধিনী সবুজ পতন, ব্রাহ্মণের উপাসনা, ইসলামের সারসংক্ষেপ ইত্যাদি।

ব্রাহ্ম সমাজের বিভাজন ও পরবর্তী পর্যায় (১৮৪১-১৮৬৯)

রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ১৮৪১ সালে ব্রাহ্ম সমাজে একটি বিভেদ দেখা দেয়। এই বিভেদের মূল কারণ ছিল ধর্মীয় মতবাদ ও সংগঠনের নীতি নিয়ে মতপার্থক্য। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের একজন প্রভাবশালী সদস্য, তিনি সমাজের রক্ষণশীল অংশের নেতৃত্ব দেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে একটি দল উপাসনার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেন এবং বিদ্যাসাগরের সমর্থন লাভ করেন।

অন্যদিকে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন রামতনু লাহিড়ী এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের মতে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবগুলি ব্রাহ্ম সমাজের মূল আদর্শের পরিপন্থী। এই মতপার্থক্যের ফলে ব্রাহ্ম সমাজ দুটি পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে যায়:

**সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ:** রামতনু লাহিড়ী ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই দল গঠিত হয়। তাঁরা ব্রাহ্ম সমাজের মূল আদর্শ ও নীতিগুলি অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়েছিলেন।
**নব ব্রাহ্ম সমাজ:** দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে এই দল গঠিত হয়। তাঁরা উপাসনার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনেন এবং আধ্যাত্মিকতার উপর বেশি জোর দেন।

পরবর্তীকালে, নব ব্রাহ্ম সমাজ আবার দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়:

**সাদারণ ব্রহ্মসমাজ:** দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন এর নেতৃত্বে এই দল গঠিত হয়।
**প্রগতিশীল ব্রহ্মসমাজ:** আনন্দচন্দ্র কার ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে এই দল গঠিত হয়।

ব্রাহ্ম সমাজের অবদান

ব্রাহ্ম সমাজ উনিশ শতকের বাংলা সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সমাজের অবদানগুলি নিম্নরূপ:

সতীদাহ প্রথা বিলোপে সহায়তা করা।
বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা।
বর্ণপ্রথা ও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা।
শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করা এবং মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামি দূর করে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানো।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়া।
বঙ্গে নারীমুক্তি আন্দোলনে সহায়তা করা।

ব্রাহ্ম সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
নাম	অবদান
রাজা রামমোহন রায়	ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সংস্কারক	দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর	ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম নেতা ও আধ্যাত্মিক গুরু	কেশবচন্দ্র সেন	ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক ও সংগঠক	রামতনু লাহিড়ী	ব্রাহ্ম সমাজের প্রাথমিক সদস্য ও সংগঠক	কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়	ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবশালী সদস্য ও সমাজসেবক	বিদ্যাসাগর	ব্রাহ্ম সমাজের supporter ও নারীশিক্ষার প্রবক্তা

ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শ ও শিক্ষা

ব্রাহ্ম সমাজের মূল আদর্শ ছিল একেশ্বরবাদ। ব্রাহ্মরা বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর এক এবং তিনি সকল জীবের মধ্যে বিরাজমান। তাঁরা উপনিষদের জ্ঞান ও যুক্তিবাদের উপর জোর দিতেন। ব্রাহ্ম সমাজের শিক্ষাগুলি নিম্নরূপ:

ঈশ্বর এক এবং তিনি সকল জীবের পিতা।
মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা উচিত নয়।
সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং সৎ পথে জীবনযাপন করা।
শিক্ষা ও জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি অর্জন করা।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া।

ব্রাহ্ম সমাজ হিন্দুধর্মের ত্রুটিগুলি দূর করে একটি আধুনিক ও মানবতাবাদী ধর্ম হিসেবে পরিচিত হতে চেয়েছিল।

বর্তমান অবস্থা

ব্রাহ্ম সমাজ বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে, তবে এর আদর্শ ও শিক্ষাগুলি আজও সমাজে প্রাসঙ্গিক। ব্রাহ্ম সমাজের কয়েকটি শাখা এখনও বিদ্যমান এবং তারা সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। ব্রাহ্ম সমাজ ভারতবর্ষের সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

Romesh Dutt, *The Economic History of India Under Early British Rule*
Partha Chatterjee, *Nationalist Thought and the Colonial World*
Sumit Sarkar, *Modern India: From the Eighteenth Century to the Present*
Sabyasachi Bhattacharya, *The Dominant Caste and Other Essays*
Jadunath Sarkar, *A History of Modern India*

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ