বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১২ সেপ্টেম্বর ১৮২০ – ২৯ জুলাই ১৮৯১) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক। তিনি বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণ এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র একজন পণ্ডিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবতাবাদী এবং দরিদ্র ও দুঃখী মানুষের বন্ধু।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার বড়নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নারায়নচন্দ্র হালদার এবং মায়ের নাম ভাগীরথী দেবী। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র হালদার। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ সত্ত্বেও, ঈশ্বরচন্দ্র অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। স্থানীয় পাঠশালায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। খুব অল্প বয়সেই তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন।

১৮৩৮ সালে তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এখানে তিনি ইংরেজি ও অন্যান্য আধুনিক বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ডেভিড হেয়ারের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হন। ১৮৪১ সালে তিনি হিন্দু কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি লরেন্স কলেজ (বর্তমানে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বিএ পাশ করেন এবং ১৮৪২ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর।

কর্মজীবন

শিক্ষা সমাপ্তির পর ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। প্রথমে তিনি ফার্সি ভাষা শেখাতেন, পরে ইতিহাস ও ভূগোলের মতো বিষয়েও তাঁর পাঠদান শুরু হয়। ১৮৫১ সালে তিনি সেন্ট্রাল কলেজের principal হিসেবে নিযুক্ত হন। এই সময়ে তিনি শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বিদ্যাসাগর বেঙ্গল গেজেট নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, যেখানে তিনি সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও কুসংস্কার নিয়ে লেখা প্রকাশ করতেন। তিনি বিধবা বিবাহ প্রথাকে সমর্থন করেন এবং এর পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর प्रयत्নে ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়।

সমাজ সংস্কারে অবদান

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারক। তিনি সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ এবং জাতিভেদ প্রথার মতো সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন। তাঁর प्रयत्নে বেথুন সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা নারী শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিদ্যাসাগর দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জীবনমান উন্নয়নেও কাজ করেছেন। তিনি কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারে একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে অনাথ ও দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা ও আশ্রয় প্রদান করা হতো।

ভাষা ও সাহিত্য

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার একজন মহান ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যের আধুনিকীকরণে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি বর্ণপরিচয় নামক একটি বই রচনা করেন, যা বাংলা ভাষা শেখার প্রাথমিক পাঠ্য হিসেবে আজও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, তিনি রায়ওয়ানচন্দ্রমঙ্গল, বিদ্যাসাগরের ভ্রমণ, এবং জীবনচরিত-এর মতো বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর লেখাগুলি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাবলী
ক্র. নং.	রচনা	প্রকাশের বছর
১	বর্ণপরিচয়	১৮৫৬
২	রায়ওয়ানচন্দ্রমঙ্গল	১৮৬৯
৩	বিদ্যাসাগরের ভ্রমণ	১৮৭৪
৪	জীবনচরিত	১৮৬৮
৫	আত্মজীবনী	১৮৮৬
৬	বাল্যচরিত্র	১৮৬৮

রাজনৈতিক অবদান

যদিও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না, তবে তাঁর সমাজ সংস্কারমূলক কাজগুলি রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রভাব ফেলেছিল। তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে শিক্ষা সংস্কার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন জানান। তাঁর লেখা ও বক্তৃতা জনমত গঠনে সহায়ক ছিল, যা পরবর্তীতে স্বতন্ত্র্য আন্দোলনকে প্রভাবিত করে।

দর্শন ও আদর্শ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দর্শন ছিল মানবতাবাদী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়। তিনি শিক্ষা, জ্ঞান এবং সচেতনতার মাধ্যমে সমাজকে উন্নত করার কথা বলতেন। তাঁর আদর্শ ছিল সত্য, ন্যায় এবং অহিংসা। তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং তাঁর জীবন ছিল ত্যাগের উদাহরণ।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই কলকাতায় মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য জগতে গভীর শোক নেমে আসে। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে শিক্ষা, সমাজ সংস্কার এবং ভাষার উন্নয়নে যে অবদান রেখেছেন, তা আজও স্মরণীয়।

বিদ্যাসাগর আজও বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত মেদিনীপুরে পূজিত হন। প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। তাঁর আদর্শ ও কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

এই নিবন্ধটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এখানে তাঁর অবদান, দর্শন এবং আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি, এই নিবন্ধটি পাঠককে বিদ্যাসাগরের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সাহায্য করবে।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ