পুঁজিবাজারের ইতিহাস

সূচনা

পूँজিবাজারের ইতিহাস মানব সভ্যতার অর্থনৈতিক বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সময়ের সাথে সাথে এই বাজারগুলি বিভিন্ন রূপ নিয়েছে, যা বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করেছে। এই নিবন্ধে, পুঁজিবাজারের উৎপত্তির পর থেকে বর্তমান পর্যায় পর্যন্ত এর বিবর্তন এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি নিয়ে আলোচনা করা হলো।

প্রাচীন যুগ

পूँজিবাজারের ধারণা প্রাচীনকালে শুরু হয়েছিল, যদিও আধুনিক পুঁজিবাজারের মতো কাঠামো তখন ছিল না।

মেসোপটেমিয়া এবং প্রাচীন মিশর-এ কৃষিপণ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের লেনদেন হতো।
ফিনিকীয় ব্যবসায়ীরা সমুদ্রপথে বাণিজ্য করত এবং বিভিন্ন বন্দরে পণ্য কেনাবেচা করত।
রোমান সাম্রাজ্য-এ শেয়ার্ড ownership-এর ধারণা বিদ্যমান ছিল, যেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগে বিনিয়োগ করা হতো।

মধ্যযুগ

মধ্যযুগে ইউরোপে পুঁজিবাজারের প্রাথমিক রূপ দেখা যায়।

ইতালির ভেনিস এবং জেনোয়ার মতো শহরগুলি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হতো এবং ঋণ প্রদান করা হতো।
হ্যানসেয়্যাটিক লীগ (Hanseatic League) মধ্যযুগের ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক জোট ছিল, যা বিভিন্ন শহরের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছিল।
১২শ শতাব্দীতে বেলজিয়াম-এর ব্রুজ শহরে পণ্য বাজারের (commodity exchange) সূচনা হয়।

আধুনিক পুঁজিবাজারের সূচনা

আধুনিক পুঁজিবাজারের যাত্রা শুরু হয় নেদারল্যান্ডসে।

ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (Dutch East India Company) ১৬০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্বের প্রথম কোম্পানি, যারা নিয়মিতভাবে শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। অ্যামস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জ (Amsterdam Stock Exchange) এই কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যা বিশ্বের প্রাচীনতম স্টক এক্সচেঞ্জ হিসেবে পরিচিত।
এই সময়ে, লন্ডনে কফি হাউসে ব্যবসায়ীরা একত্রিত হয়ে বাণিজ্য করত, যা পরবর্তীতে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ-এর (London Stock Exchange) ভিত্তি স্থাপন করে।

১৮ ও ১৯ শতক

এই শতাব্দীতে পুঁজিবাজারের দ্রুত বিস্তার ঘটে।

ফ্রান্সে প্যারিস স্টক এক্সচেঞ্জ (Paris Stock Exchange) প্রতিষ্ঠিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ (New York Stock Exchange) ১৭৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্বের বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জগুলির মধ্যে অন্যতম।
শিল্প বিপ্লবের ফলে কোম্পানিগুলির সম্প্রসারণের জন্য পুঁজির চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা পুঁজিবাজারের উন্নতিতে সহায়ক হয়।
রেলওয়ে কোম্পানিগুলি ব্যাপকহারে শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।

বিংশ শতাব্দী

বিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।

১৯২৯ সালের মহামন্দা: এই অর্থনৈতিক সংকট পুঁজিবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ (Wall Street Crash) বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং বাজার ধসে পড়ে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (Securities and Exchange Commission - SEC) ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা এবং বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাজারের পুনরুদ্ধার হয় এবং নতুন প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে বাজারের পরিধি আরও বৃদ্ধি পায়।
কম্পিউটারাইজেশন: ১৯৬০-এর দশকে কম্পিউটারের ব্যবহার পুঁজিবাজারে লেনদেন প্রক্রিয়াকে দ্রুত এবং সহজ করে তোলে।
বৈশ্বিকীকরণ: বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় পুঁজিবাজারগুলি একে অপরের সাথে আরও বেশি সংযুক্ত হয়।

একবিংশ শতাব্দী

একবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাজার প্রযুক্তিগত দিক থেকে আরও উন্নত হয়েছে।

ইন্টারনেটের ব্যবহার: অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মগুলি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজারের সুযোগ আরও সহজলভ্য করে তুলেছে।
উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি ট্রেডিং (High-Frequency Trading - HFT): অত্যাধুনিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে দ্রুত গতিতে লেনদেন করার পদ্ধতি চালু হয়েছে।
ডেরিভেটিভস (Derivatives): ফিউচার, অপশন এবং অন্যান্য ডেরিভেটিভস পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। বাইনারি অপশন (Binary Option) তেমনই একটি ডেরিভেটিভ পণ্য।
ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস (Financial Crisis): ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট পুঁজিবাজারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
ব্লকচেইন প্রযুক্তি (Blockchain technology) এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency)-এর উত্থান পুঁজিবাজারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজার

বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ (NYSE) এবং নাসডাক (NASDAQ) বিশ্বের বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ।
জাপান: টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (Tokyo Stock Exchange) এশিয়ার বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ।
চীন: সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ (Shanghai Stock Exchange) এবং শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ (Shenzhen Stock Exchange) চীনের প্রধান পুঁজিবাজার।
ভারত: বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ (Bombay Stock Exchange - BSE) এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (National Stock Exchange - NSE) ভারতের প্রধান পুঁজিবাজার।
যুক্তরাজ্য: লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ (London Stock Exchange) ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুঁজিবাজার।

পুঁজিবাজারের কার্যাবলী

পুঁজিবাজার নিম্নলিখিত কার্যাবলী সম্পাদন করে:

মূলধন গঠন: কোম্পানিগুলিকে শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।
বিনিয়োগের সুযোগ: বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার এবং অন্যান্য আর্থিক উপকরণে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করে।
মূল্য নির্ধারণ: বাজারের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: ডেরিভেটিভস এবং অন্যান্য আর্থিক উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে, নতুন শিল্প এবং ব্যবসার প্রসারে উৎসাহিত করে।

পুঁজিবাজারের প্রকারভেদ

পুঁজিবাজারকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:

প্রাথমিক বাজার (Primary Market): যেখানে কোম্পানিগুলি প্রথমবার শেয়ার ইস্যু করে জনসাধারণের কাছে বিক্রি করে। আইপিও (IPO) এর মাধ্যমে এই শেয়ার বিক্রি করা হয়।
গৌণ বাজার (Secondary Market): যেখানে আগে ইস্যু করা শেয়ারগুলি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কেনাবেচা হয়। স্টক এক্সচেঞ্জগুলি গৌণ বাজারের অংশ।

টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ

টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ হলো বাজারের গতিবিধি এবং প্রবণতা বিশ্লেষণের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক মূল্য এবং ভলিউম ডেটা ব্যবহার করে ভবিষ্যতের মূল্য নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়।

চার্ট প্যাটার্ন (Chart Pattern): বিভিন্ন চার্ট প্যাটার্ন যেমন হেড অ্যান্ড শোল্ডারস, ডাবল টপ, ডাবল বটম ইত্যাদি ব্যবহার করে বাজারের ভবিষ্যৎ গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
মুভিং এভারেজ (Moving Average): নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গড় মূল্য হিসাব করে বাজারের প্রবণতা নির্ণয় করা হয়।
আরএসআই (RSI - Relative Strength Index): একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেয়ারের দামের আপেক্ষিক শক্তি পরিমাপ করা হয়।
এমএসিডি (MACD - Moving Average Convergence Divergence): দুটি মুভিং এভারেজের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বাজারের মোমেন্টাম বোঝা যায়।
ফিবোনাচ্চি রিট্রেসমেন্ট (Fibonacci Retracement): ফিবোনাচ্চি সংখ্যা ব্যবহার করে সম্ভাব্য সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স লেভেল নির্ধারণ করা হয়।

ভলিউম বিশ্লেষণ

ভলিউম বিশ্লেষণ হলো বাজারের লেনদেনের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে বাজারের গতিবিধি বোঝার একটি পদ্ধতি।

ভলিউম স্প্রেড (Volume Spread): মূল্য এবং ভলিউমের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বাজারের শক্তি বা দুর্বলতা বোঝা যায়।
অন ব্যালেন্স ভলিউম (On Balance Volume - OBV): ভলিউমের পরিবর্তন এবং দামের পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বাজারের প্রবণতা নির্ণয় করা হয়।
অ্যাকুমুলেশন/ডিস্ট্রিবিউশন লাইন (Accumulation/Distribution Line): বাজারের Accumulation এবং Distribution পর্যায় চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।

ঝুঁকি ও সতর্কতা

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিনিয়োগকারীদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনে রাখা উচিত:

বাজারের ঝুঁকি (Market Risk): বাজারের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগের মূল্য হ্রাস পেতে পারে।
কোম্পানি-নির্দিষ্ট ঝুঁকি (Company-Specific Risk): কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে বিনিয়োগের মূল্য কমতে পারে।
তারল্য ঝুঁকি (Liquidity Risk): দ্রুত সম্পদ বিক্রি করতে না পারার ঝুঁকি।
সুদের হারের ঝুঁকি (Interest Rate Risk): সুদের হারের পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগের মূল্য প্রভাবিত হতে পারে।
মুদ্রার ঝুঁকি (Currency Risk): মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগের মূল্য কমতে পারে।

বিনিয়োগের আগে ভালোভাবে গবেষণা করা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।

উপসংহার

পুঁজিবাজারের ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল। সময়ের সাথে সাথে এই বাজারগুলি পরিবর্তিত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আধুনিক পুঁজিবাজার প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক উন্নত হলেও, বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং সঠিক জ্ঞান ও কৌশল ব্যবহার করে বিনিয়োগ করতে হবে।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ