ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ

ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ বলতে সাধারণত ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার-এর আকস্মিক পতনকে বোঝানো হয়। এটি অর্থনৈতিক মহামন্দার সূচনাকারী হিসেবে বিবেচিত হয়, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। এই ঘটনাটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং এর ফলস্বরূপ ব্যাপক আর্থিক সংকট দেখা দেয়।

পটভূমি

১৯২০-এর দশকে মার্কিন অর্থনীতি বেশ দ্রুত বিকাশ লাভ করছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে উৎপাদন বৃদ্ধি, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ক্রেডিট ব্যবস্থার সহজলভ্যতা অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই সময়ে স্টক মার্কেট ঊর্ধ্বমুখী ছিল, এবং বহু মানুষ বিনিয়োগ করে লাভবান হচ্ছিল। মনে করা হচ্ছিল, এই ঊর্ধ্বগতি চলতেই থাকবে। এই ধারণা ‘দৃষ্টিভ্রম’ তৈরি করে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা সম্পদের প্রকৃত মূল্য বিবেচনা না করে কেবল দাম বাড়ার আশায় বিনিয়োগ করতে থাকে।

ক্র্যাশের কারণসমূহ

ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশের পেছনে একাধিক কারণ ছিল। এর মধ্যে কিছু প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

অতিরিক্ত মূল্যায়ন (Overvaluation): অনেক স্টকের দাম তাদের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ভবিষ্যৎ আয় সম্পর্কে অতি-আশাবাদী ছিলেন, যার ফলে স্টকগুলোর দাম কৃত্রিমভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
ঋণ এবং লিভারেজ (Debt and Leverage): বিনিয়োগকারীরা প্রায়শই ধার করা অর্থ দিয়ে স্টক কিনতেন, যা লিভারেজ নামে পরিচিত। লিভারেজের কারণে সামান্য দাম কমলেই বড় ধরনের লোকসান হতে পারত। মার্জিন কল বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করে।
উৎপাদন হ্রাস (Production Slowdown): ১৯২০-এর দশকের শেষ দিকে উৎপাদন বৃদ্ধি ধীর হয়ে আসে। এর ফলে কোম্পানির মুনাফা কমতে শুরু করে, যা স্টকের দামের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বৈদেশিক বাণিজ্য সমস্যা (Foreign Trade Problems): বৈশ্বিক বাণিজ্যে সমস্যা দেখা দেয়, যা মার্কিন অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়।
আর্থিক নীতি (Monetary Policy): ফেডারেল রিজার্ভের ভুল আর্থিক নীতি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।

ক্র্যাশের ঘটনাপ্রবাহ

১৯২৯ সালের অক্টোবরে শেয়ার বাজারে পতন শুরু হয়। এই পতন কয়েকটি ধাপে ঘটেছিল:

২৪ অক্টোবর, ১৯২৯ (ব্ল্যাক থার্সডে): এই দিনে শেয়ার বাজারে ব্যাপক দরপতন হয়। প্রায় ১৩ মিলিয়ন শেয়ার বিক্রি হয়ে যায়, এবং ডাউ জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।
২৮ অক্টোবর, ১৯২৯ (ব্ল্যাক মানডে): এটি ছিল ক্র্যাশের সবচেয়ে খারাপ দিন। এই দিনে প্রায় ১৬ মিলিয়ন শেয়ার বিক্রি হয়, এবং বাজার সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে।
২৯ অক্টোবর, ১৯২৯ (ব্ল্যাক টিউজডে): ব্ল্যাক মানডের মতোই এই দিনেও ব্যাপক বিক্রি চাপ সৃষ্টি হয় এবং বাজার আরও পড়ে যায়।

ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশের সময় ডাউ জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজের পরিবর্তন
তারিখ	ডাউ জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ
২৪ অক্টোবর, ১৯২৯	২৯৯.০৭
২৮ অক্টোবর, ১৯২৯	১৯৫.৭৮
২৯ অক্টোবর, ১৯২৯	২৪৮.৪৬
১৩ নভেম্বর, ১৯২৯	১৯১.৭৭

প্রভাব

ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এর কিছু প্রধান প্রভাব নিচে উল্লেখ করা হলো:

অর্থনৈতিক মহামন্দা (Great Depression): এই ক্র্যাশ অর্থনৈতিক মহামন্দার সূত্রপাত করে, যা ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে চরম সংকট দেখা দেয়।
বেকারত্ব বৃদ্ধি (Increased Unemployment): মহামন্দার কারণে ব্যাপক হারে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। বহু মানুষ কাজ হারিয়ে ফেলে এবং দারিদ্র্য চরম আকার ধারণ করে।
ব্যাংকসমূহের পতন (Bank Failures): অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়, কারণ তারা স্টকে বিনিয়োগ করে লোকসান করেছিল এবং ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি (Losses for Investors): বহু বিনিয়োগকারী তাদের সমস্ত সঞ্চয় হারিয়ে ফেলে।
সামাজিক অস্থিরতা (Social Unrest): অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয় এবং বিক্ষোভ শুরু হয়।

বাইনারি অপশন ট্রেডিং এবং ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ

বাইনারি অপশন ট্রেডিং একটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক আর্থিক উপকরণ। ১৯২৯ সালের ক্র্যাশের সময় বাইনারি অপশন ছিল না, তবে এই ধরনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাইনারি অপশন ট্রেডাররা তাদের কৌশল তৈরি করতে পারে।

ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (Risk Management): ক্র্যাশ দেখায় যে বাজারে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে। বাইনারি অপশন ট্রেডারদের উচিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং স্টপ-লস অর্ডার ব্যবহার করা।
বৈচিত্র্যকরণ (Diversification): বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আনা জরুরি। শুধুমাত্র একটি সম্পদে বিনিয়োগ না করে বিভিন্ন ধরনের সম্পদে বিনিয়োগ করা উচিত।
বাজার বিশ্লেষণ (Market Analysis): টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ, ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ করে বাজারের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
সংবাদ এবং ঘটনা (News and Events): অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খবর এবং ঘটনাগুলোর উপর নজর রাখা উচিত, কারণ এগুলো বাজারের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।