মেসোপটেমিয়া

ভূমিকা

মেসোপটেমিয়া, যার অর্থ "নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী ভূমি" (গ্রিক শব্দ Μεσoποταμία থেকে আগত), প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এটি মূলত আধুনিক ইরাক, কুয়েত, সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব অংশ এবং তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ নিয়ে গঠিত। প্রাচীন ইতিহাস-এর প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলটি মানব সভ্যতা বিকাশের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হয়। মেসোপটেমিয়ার উর্বর ভূমি কৃষি ও জনবসতির জন্য অনুকূল ছিল, যা এখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই নিবন্ধে মেসোপটেমিয়ার ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ভূগোল

মেসোপটেমিয়া দুটি প্রধান নদীর – টাইগ্রিস নদী ও ইউফ্রেটিস নদী – মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এই নদী দুটি পারস্য উপসাগরে পতিত হয়েছে। অঞ্চলটি মূলত একটি বিশাল সমভূমি, যা উত্তর ও পূর্বে Zagros পর্বতমালা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আরবীয় মরুভূমি দ্বারা বেষ্টিত। মেসোপটেমিয়ার ভূ-প্রকৃতিকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা যায়:

উত্তর মেসোপটেমিয়া: এটি পার্বত্য অঞ্চল, যা মূলত কুর্দিস্তান নামে পরিচিত।
মধ্য মেসোপটেমিয়া: এই অঞ্চলটি উর্বর পলল সমভূমি, যা কৃষি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।
দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া: এটি নদী বদ্বীপ অঞ্চল, যেখানে অসংখ্য ছোট ছোট নদী ও খাল রয়েছে।

এই অঞ্চলের মাটি অত্যন্ত উর্বর হওয়ায় এখানে প্রাচীনকাল থেকেই শস্য, ফল এবং সবজি উৎপাদন করা হতো।

ইতিহাস

মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস প্রায় ১০,০০০ বছর আগের। এখানে ধারাবাহিক কয়েকটি সভ্যতা বিকাশ লাভ করে, যা মানব ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছে।

সুমেরীয় সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০-৩০০০): মেসোপটেমিয়ার প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে সুমেরীয়রা অন্যতম। তারা নগর-রাষ্ট্র গঠন করে, যেমন উর, লাগাশ, কিশ ইত্যাদি। সুমেরীয়রা লিখন পদ্ধতি-র (কিউনিফর্ম) উদ্ভাবন করে এবং জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও স্থাপত্য-এর উন্নতি ঘটায়।
আক্কাদীয় সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২৩৩৪-২১৫৯): সারগন নামক একজন শক্তিশালী শাসক আক্কাদীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুমেরীয় নগর-রাষ্ট্রগুলিকে একত্রিত করেন।
ব্যাবিলোনীয় সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০-৫৩৯): হাম্মুরাবি-র আইন সংহিতা (হাম্মুরাবির বিধি ) এই সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ব্যাবিলোনীয়রা গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সাহিত্য -এর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৯১১-৬১০): অ্যাসিরীয়রা ছিল একজন শক্তিশালী সামরিক শক্তি। তারা বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করে এবং যুদ্ধ কৌশলের উন্নতি ঘটায়। নিনভে ছিল তাদের রাজধানী।
নব্য-ব্যাবিলোনীয় সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৬২৬-৫৫৬): নবুখাদনেজার ২-এর শাসনামলে এই সাম্রাজ্য চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছিল। তিনি বাবিলের শূন্য উদ্যান নির্মাণ করেন, যা প্রাচীন বিশ্বের সাতটি বিস্ময়-এর মধ্যে অন্যতম।
পারস্য সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৯-৩৩১): সাইরাস দ্য গ্রেট পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং মেসোপটেমিয়া সহ বিশাল অঞ্চল জয় করেন।

সংস্কৃতি

মেসোপটেমিয়ার সংস্কৃতি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে এই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল।

ধর্ম: মেসোপটেমিয়ার লোকেরা বহু দেবতা ও দেবীর পূজা করত। তাদের প্রধান দেবতাদের মধ্যে ছিলেন আন, এনলিল, এন্কী এবং ইштар। তারা মন্দির নির্মাণ করত, যেখানে দেবদেবীর মূর্তি স্থাপন করা হতো।
ভাষা ও সাহিত্য: সুমেরীয়, আক্কাদীয়, অ্যাসিরীয় এবং ব্যবিলোনীয় – এই চারটি প্রধান ভাষা মেসোপটেমিয়ায় প্রচলিত ছিল। গিলগামেশ মহাকাব্য মেসোপটেমিয়ার সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
শিল্পকলা ও স্থাপত্য: মেসোপটেমিয়ার শিল্পকলায় ভাস্কর্য, চিত্রকলা এবং অলঙ্কার শিল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা ইট ও মাটি দিয়ে বিশাল স্থাপনা নির্মাণ করত, যেমন জিগুরাত (মন্দির)।
সামাজিক কাঠামো: মেসোপটেমিয়ার সমাজ ছিল শ্রেণীবিন্যাসিত। রাজা, যাজক, অভিজাত এবং সাধারণ মানুষ – এই চারটি প্রধান শ্রেণী ছিল।

অর্থনীতি

মেসোপটেমিয়ার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর ছিল। উর্বর জমির কারণে এখানে প্রচুর শস্য, ফল ও সবজি উৎপাদিত হতো।

কৃষি: সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিকাজ করা হতো। যব, গম, খর্জুর এবং তিল ছিল প্রধান শস্য।
বাণিজ্য: মেসোপটেমিয়ার লোকেরা বৈদেশিক বাণিজ্য-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা কাঠ, ধাতু, রেশম এবং অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য আমদানি ও রপ্তানি করত।
হস্তশিল্প: কুমোর, কামার, তন্তু প্রস্তুতকারক এবং অলঙ্কার প্রস্তুতকারকরা হস্তশিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।
মুদ্রা: মেসোপটেমিয়ায় রূপা ও তামা-র তৈরি মুদ্রা ব্যবহৃত হতো।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মেসোপটেমিয়ার লোকেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

গণিত: তারা ষাট ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করত, যা আজও সময় ও কোণ পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয়।
জ্যোতির্বিদ্যা: মেসোপটেমীয়রা নক্ষত্র ও গ্রহ পর্যবেক্ষণ করে পঞ্জিকা তৈরি করত।
চিকিৎসা: তারা জৈব রসায়ন এবং ফার্মাকোলজি-র প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেছিল।
লিখন পদ্ধতি: কিউনিফর্ম লিপির উদ্ভাবন মানব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা।
সেচ ব্যবস্থা: তারা নদী থেকে জল সেচের জন্য খাল খনন করত, যা কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য ছিল।