তেলের ইতিহাস
তেলের ইতিহাস
ভূমিকা
তেল, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত, তেল কেবল জ্বালানির উৎস হিসেবেই নয়, বরং অর্থনীতি, রাজনীতি এবং প্রযুক্তির চালিকাশক্তি হিসেবেও কাজ করেছে। এই নিবন্ধে তেলের ইতিহাস, এর উৎস, উত্তোলন পদ্ধতি, ব্যবহার এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
প্রাচীন যুগ
তেলের ব্যবহার নতুন নয়। প্রাচীনকালে মেসোপটেমিয়া এবং মিশর-এর সভ্যতায় তেল ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন নির্মাণকাজে, যেমন - জাহাজের কাঠামো নির্মাণ, দেয়াল তৈরিতে এবং প্রদীপ জ্বালানোর কাজে। এছাড়াও, প্রাচীন রোমান ও গ্রিকরা তেলকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করত। বাইবেলেও তেলের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে, এই সময়ে তেল মূলত ভূমিরূপ থেকে সংগ্রহ করা হতো, যা প্রাকৃতিক উৎস থেকে নির্গত হতো।
মধ্যযুগ
মধ্যযুগে তেলের ব্যবহার সীমিত ছিল। তবে, আরব বিশ্বে তেল উৎপাদন এবং পরিশোধন কিছুটা উন্নত হয়েছিল। তারা তেলকে বাতি জ্বালানোর কাজে এবং ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার করত। এই সময়ে, তেল মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং মধ্যপ্রাচ্য-এর স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা হতো।
শিল্প বিপ্লব
শিল্প বিপ্লব (১৭৬০-১৮৪০) তেলের ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন এবং নতুন নতুন যন্ত্রপাতির আবিষ্কারের ফলে জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। শুরুতে কয়লা প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, ধীরে ধীরে তেলের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। এডউইন ড্রേക്ക് ১৮৫৯ সালে পেনসিলভানিয়ায় প্রথম সফল তেল কূপ খনন করেন, যা আধুনিক তেল শিল্পের সূচনা করে। এই আবিষ্কারের ফলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দী
ঊনবিংশ শতাব্দীতে তেলের চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকে। কেরোসিন তেলের ব্যবহার বাতি জ্বালানোর জন্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। জন ডি রকফেলার-এর স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি এই সময়ে তেল শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করে। কোম্পানিটি তেল উৎপাদন, পরিশোধন এবং বিতরণের ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এই সময়ে, তেল মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে উত্তোলন করা হতো।
বিংশ শতাব্দী
বিংশ শতাব্দীতে তেলের ব্যবহার আরও ব্যাপক হয়। অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিন-এর আবিষ্কারের ফলে গাড়ি, বিমান এবং অন্যান্য যানবাহন তৈরিতে তেল অপরিহার্য হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তেলের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়, কারণ যুদ্ধযান এবং সামরিক সরঞ্জাম চালানোর জন্য তেলের প্রয়োজন ছিল।
১৯৩০-এর দশকে মধ্যপ্রাচ্য-এ তেলের বিশাল মজুদ আবিষ্কৃত হয়। সৌদি আরব, ইরান, ইরাক এবং কুয়েত বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়। এই সময়ে, তেল কোম্পানিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে চুক্তি করে তেল উত্তোলনের অধিকার লাভ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নও এই সময়ে নিজেদের তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল সরবরাহকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তেলের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সাথে সাথে তেল ব্যবহারের পরিমাণ বাড়তে থাকে। পেট্রোলিয়াম শিল্প দ্রুত প্রসারিত হয় এবং নতুন নতুন তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।
১৯৭০-এর দশকে ওপেক (OPEC - Organization of the Petroleum Exporting Countries) গঠিত হয়। এই সংস্থাটি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৭৩ সালের তেল সংকট বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে, যখন ওপেক তেল সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং তেলের দাম অনেক বেড়ে যায়।
একবিংশ শতাব্দী
একবিংশ শতাব্দীতে তেলের চাহিদা আরও বাড়ছে, বিশেষ করে চীন এবং ভারত-এর মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তবে, তেলের মজুদ সীমিত এবং পরিবেশ দূষণের কারণে বিকল্প জ্বালানির উৎস খোঁজা হচ্ছে। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, যেমন - সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি এবং জৈব জ্বালানি -র ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
তেল উত্তোলনের পদ্ধতি
তেল উত্তোলনের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। নিচে কয়েকটি প্রধান পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
- ভূগর্ভস্থ খনন: এই পদ্ধতিতে কূপ খনন করে তেল সংগ্রহ করা হয়। এটি সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি।
- সমুদ্র তলদেশ খনন: সমুদ্রের নিচে তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলনের জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
- ফ্র্যাকিং: শেলের মধ্যে আটকে থাকা তেল এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
- উন্নত তেল পুনরুদ্ধার: এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে তেলক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হয়।
তেলের ব্যবহার
তেলের বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। নিচে কয়েকটি প্রধান ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
- জ্বালানি: পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ইত্যাদি জ্বালানি তৈরিতে তেল ব্যবহৃত হয়।
- প্লাস্টিক: প্লাস্টিক উৎপাদনের প্রধান উপাদান হলো তেল।
- রাসায়নিক শিল্প: বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, যেমন - সার, কীটনাশক, ওষুধ ইত্যাদি তৈরিতে তেল ব্যবহৃত হয়।
- পরিবহন: সড়ক, রেল এবং বিমান পথে পরিবহনের জন্য তেল অপরিহার্য।
- বিদ্যুৎ উৎপাদন: অনেক দেশে তেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
বিশ্ব অর্থনীতিতে তেলের প্রভাব
তেল বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তেলের দামের পরিবর্তন বিশ্ব অর্থনীতির উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ে, যা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, তেলের দাম কমলে অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি আসে।
তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেলের রপ্তানি থেকে প্রচুর আয় করে। এই আয় তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক। তবে, তেলের উপর अत्यधिक নির্ভরশীলতা অনেক দেশের জন্য একটি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ভবিষ্যৎ
তেলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তেলের মজুদ সীমিত এবং পরিবেশ দূষণের কারণে এর ব্যবহার কমানোর চাপ বাড়ছে। বিকল্প জ্বালানির উৎসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করছে, যা তেলের চাহিদা কমাতে পারে। তবে, আগামী কয়েক দশকে তেল এখনও বিশ্বের প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ
তেলের বাজার বিশ্লেষণ করার জন্য টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ (যেমন: চার্ট প্যাটার্ন, মুভিং এভারেজ, আরএসআই) এবং ভলিউম বিশ্লেষণ (যেমন: ভলিউম ওয়েটেড এভারেজ প্রাইস, অন ব্যালেন্স ভলিউম) গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে বাজারের গতিবিধি এবং ভবিষ্যৎ প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
- ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট: তেলের দামের গতিবিধি বুঝতে সহায়ক।
- ফিবিonacci রিট্রেসমেন্ট: সম্ভাব্য সাপোর্ট এবং রেজিস্টেন্স লেভেল সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়।
- MACD (Moving Average Convergence Divergence): ট্রেন্ডের দিক এবং শক্তি নির্ধারণ করে।
- বলিঙ্গার ব্যান্ড: দামের অস্থিরতা পরিমাপ করে।
- স্টোকাস্টিক অসিলেটর: ওভারবট এবং ওভারসোল্ড অবস্থা সনাক্ত করে।
উপসংহার
তেলের ইতিহাস মানবসভ্যতার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তেল আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে, তেলের সীমিত মজুদ এবং পরিবেশগত প্রভাবের কারণে বিকল্প জ্বালানির উৎস খোঁজা জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্থিতিশীল এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে তেলের বিকল্প উৎসের উপর জোর দিতে হবে।
শক্তি নীতি জ্বালানি অর্থনীতি পেট্রোলিয়াম ভূগোল তেল সংকট ওপেক পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সৌর শক্তি বায়ু শক্তি জৈব জ্বালানি টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ ভলিউম বিশ্লেষণ চার্ট প্যাটার্ন মুভিং এভারেজ আরএসআই ভলিউম ওয়েটেড এভারেজ প্রাইস অন ব্যালেন্স ভলিউম ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট ফিবিonacci রিট্রেসমেন্ট MACD বলিঙ্গার ব্যান্ড স্টোকাস্টিক অসিলেটর
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
