ফ্র্যাকিং

ফ্র্যাকিং : একটি বিস্তারিত আলোচনা

ফ্র্যাকিং, যা হাইড্রোফ্র্যাকিং বা স্টেজড গ্যাস ফ্র্যাকচারিং নামেও পরিচিত, একটি বিতর্কিত প্রক্রিয়া। এটি তেল ক্ষেত্র এবং গ্যাস ক্ষেত্র থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস বা পেট্রোলিয়াম আহরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে, শিলাস্তরের মধ্যে ফাটল তৈরি করার জন্য উচ্চ চাপযুক্ত তরল মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়, যার ফলে গ্যাস বা তেল নির্গত হতে পারে। ফ্র্যাকিংয়ের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। এই নিবন্ধে, ফ্র্যাকিংয়ের প্রক্রিয়া, ইতিহাস, সুবিধা, অসুবিধা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ফ্র্যাকিং এর প্রাথমিক ধারণা

ফ্র্যাকিং একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর মূল উদ্দেশ্য হলো এমন শিলাস্তরের মধ্যে প্রবেশ করা যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানি আটকা পড়ে আছে। এই শিলাস্তরগুলো সাধারণত ভেদ্য (permeable) হয় না, অর্থাৎ এদের মধ্যে দিয়ে গ্যাস বা তরল সহজে প্রবাহিত হতে পারে না। ফ্র্যাকিং এই ভেদ্যতাহীন শিলাস্তরের মধ্যে ফাটল তৈরি করে, যা গ্যাস বা তেলকে কূপের দিকে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে।

ফ্র্যাকিং এর ইতিহাস

ফ্র্যাকিংয়ের ধারণাটি নতুন নয়। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯ শতকে।

• প্রথম দিকের প্রচেষ্টা (১৯ শতক):: ১৮৬২ সালে, কর্নেল এডওয়ার্ড রবার্টস প্রথম ফ্র্যাকিংয়ের ধারণা দেন এবং বিস্ফোরক ব্যবহার করে তেল কূপের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করেন।
• আধুনিক ফ্র্যাকিং এর সূচনা (১৯৪৯):: ১৯৪৯ সালে, হ্যালিবার্টন অয়েল ওয়েল সিমেন্টিং কোম্পানি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল হাইড্রোফ্র্যাকিং কৌশল তৈরি করে। তারা অ্যাসিড এবং বেগুনের মিশ্রণ ব্যবহার করে শিলাস্তরে ফাটল তৈরি করে।
• শেল গ্যাস বিপ্লব (২০০০-বর্তমান):: ২০০০-এর দশকে, অনুভূমিক ড্রিলিং (horizontal drilling) এবং ফ্র্যাকিংয়ের সমন্বয় শেল গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায়। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এবং শক্তি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

ফ্র্যাকিং প্রক্রিয়া

ফ্র্যাকিং প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:

১. কূপ খনন ও প্রস্তুতি: প্রথমে, উল্লম্বভাবে কূপ খনন করা হয় এবং এরপর এটিকে অনুভূমিকভাবে শিলাস্তরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। কূপের চারপাশে সিমেন্ট দিয়ে আস্তরণ করা হয় যাতে ভূগর্ভস্থ জল দূষিত না হয়।

২. ফ্র্যাকচারিং ফ্লুইড তৈরি: ফ্র্যাকচারিং ফ্লুইড হলো জল, বালি এবং রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ। এই মিশ্রণে প্রায় ৯৫% জল, ৫% বালি এবং সামান্য পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ থাকে। রাসায়নিক পদার্থগুলো শিলার ভেদ্যতা বাড়াতে এবং ঘর্ষণ কমাতে সাহায্য করে।

৩. উচ্চ চাপ প্রয়োগ: ফ্র্যাকচারিং ফ্লুইডকে উচ্চ চাপে শিলাস্তরের মধ্যে পাম্প করা হয়। এই চাপ শিলাস্তরে ফাটল তৈরি করে। বালি ফাটলগুলো খোলা রাখতে সাহায্য করে, যাতে গ্যাস বা তেল সহজে প্রবাহিত হতে পারে।

৪. গ্যাস বা তেল সংগ্রহ: ফাটল তৈরি হওয়ার পর, গ্যাস বা তেল কূপের মাধ্যমে উপরে আনা হয়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে।

ফ্র্যাকিং প্রক্রিয়ার ধাপসমূহ

বিবরণ |
কূপ খনন ও প্রস্তুতি | উল্লম্ব ও অনুভূমিক কূপ খনন এবং সিমেন্ট আস্তরণ। |	ফ্র্যাকচারিং ফ্লুইড তৈরি | জল, বালি ও রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ তৈরি। |	উচ্চ চাপ প্রয়োগ | ফ্লুইডকে উচ্চ চাপে শিলাস্তরে পাম্প করা। |	গ্যাস বা তেল সংগ্রহ | কূপের মাধ্যমে গ্যাস বা তেল উত্তোলন। |

ফ্র্যাকিং এর সুবিধা

ফ্র্যাকিংয়ের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে:

• জ্বালানি নিরাপত্তা: ফ্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে দেশীয় জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যা আমদানি নির্ভরতা কমায় এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
• অর্থনৈতিক উন্নয়ন: ফ্র্যাকিং শিল্প নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে উন্নত করে।
• গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি: ফ্র্যাকিং প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বাড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করে।
• শিল্পের বিকাশ: ফ্র্যাকিং সম্পর্কিত শিল্প, যেমন - ড্রিলিং, পরিবহন এবং রাসায়নিক উৎপাদন - এর বিকাশ ঘটে।

ফ্র্যাকিং এর অসুবিধা

ফ্র্যাকিংয়ের কিছু উল্লেখযোগ্য অসুবিধা রয়েছে:

• ভূগর্ভস্থ জল দূষণ: ফ্র্যাকিং ফ্লুইডে থাকা রাসায়নিক পদার্থ ভূগর্ভস্থ জলকে দূষিত করতে পারে। যদিও কূপের সিমেন্ট আস্তরণ এটি প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি করা হয়, তবুও লিকেজের ঝুঁকি থাকে।
• ভূমিকম্পের ঝুঁকি: ফ্র্যাকিংয়ের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য জল ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে, বর্জ্য জল কূপগুলোতে জমা করার সময় এই ঝুঁকি বাড়ে।
• বায়ু দূষণ: ফ্র্যাকিং প্রক্রিয়া থেকে নির্গত গ্যাস, যেমন - মিথেন, গ্রিনহাউস গ্যাস হিসাবে পরিচিত এবং এটি জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে।
• জলের ব্যবহার: ফ্র্যাকিংয়ের জন্য প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয়, যা জলসংকটপূর্ণ এলাকায় জলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
• রাসায়নিক ঝুঁকি: ফ্র্যাকিং ফ্লুইডে ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিক পদার্থ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

পরিবেশগত প্রভাব

ফ্র্যাকিংয়ের পরিবেশগত প্রভাবগুলি ব্যাপক। এর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:

• জল দূষণ: ফ্র্যাকিং ফ্লুইডের কারণে ভূগর্ভস্থ জল এবং নদী দূষিত হতে পারে।
• বায়ু দূষণ: মিথেন এবং অন্যান্য উদ্বায়ী জৈব যৌগ (VOCs) নির্গমনের মাধ্যমে বায়ু দূষিত হয়।
• ভূমি ব্যবহার: ফ্র্যাকিংয়ের জন্য কূপ এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রচুর জমির প্রয়োজন হয়।
• জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ফ্র্যাকিং এবং টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ

ফ্র্যাকিং শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

• চार्ट প্যাটার্ন: তেল এবং গ্যাসের দামের গতিবিধি বোঝার জন্য বিভিন্ন চার্ট প্যাটার্ন, যেমন - হেড অ্যান্ড শোল্ডারস, ডাবল টপ, এবং ডাবল বটম ব্যবহার করা হয়।
• মুভিং এভারেজ: মুভিং এভারেজ ব্যবহার করে দামের প্রবণতা (trend) নির্ধারণ করা যায়।
• আরএসআই (Relative Strength Index): আরএসআই ব্যবহার করে বোঝা যায় যে কোনো স্টক বা কমোডিটি অতি কেনা (overbought) নাকি অতি বিক্রি (oversold) অবস্থায় আছে।
• ভলিউম বিশ্লেষণ: ভলিউম বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাজারের চাহিদা এবং সরবরাহ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

ফ্র্যাকিং এবং ভলিউম বিশ্লেষণ

ফ্র্যাকিং কোম্পানিগুলোর শেয়ারের ভলিউম বিশ্লেষণ বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করতে পারে।

• ভলিউম স্পাইক: যদি কোনো ফ্র্যাকিং কোম্পানির শেয়ারের ভলিউম হঠাৎ করে বেড়ে যায়, তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হতে পারে।
• আপট্রেন্ডে ভলিউম বৃদ্ধি: যদি শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে এবং একই সাথে ভলিউমও বৃদ্ধি পায়, তবে এটি একটি শক্তিশালী আপট্রেন্ডের ইঙ্গিত দেয়।
• ডাউনট্রেন্ডে ভলিউম বৃদ্ধি: যদি শেয়ারের দাম কমতে থাকে এবং ভলিউমও বৃদ্ধি পায়, তবে এটি একটি শক্তিশালী ডাউনট্রেন্ডের ইঙ্গিত দেয়।

ফ্র্যাকিং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ফ্র্যাকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভরশীল।

• প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: নতুন প্রযুক্তি, যেমন - উন্নত ড্রিলিং কৌশল এবং পরিবেশ-বান্ধব ফ্র্যাকচারিং ফ্লুইড, ফ্র্যাকিংয়ের দক্ষতা এবং পরিবেশগত সুরক্ষা বাড়াতে পারে।
• নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন: সরকারের নীতি এবং নিয়ন্ত্রণ ফ্র্যাকিং শিল্পের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। কঠোর নিয়মকানুন ফ্র্যাকিংকে সীমিত করতে পারে, যেখানে সহায়ক নীতি এটিকে উৎসাহিত করতে পারে।
• বাজারের চাহিদা: প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের চাহিদা ফ্র্যাকিং শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
• পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি: সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি এবং অন্যান্য পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির প্রসারের সাথে সাথে ফ্র্যাকিংয়ের চাহিদা কমতে পারে।

ফ্র্যাকিং নিয়ে বিতর্ক

ফ্র্যাকিং নিয়ে বিতর্ক একটি চলমান প্রক্রিয়া। পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলো ফ্র্যাকিংয়ের পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, অন্যদিকে শিল্প সংস্থাগুলো এর অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো তুলে ধরে। এই বিতর্কের সমাধান খোঁজার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা, কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং স্বচ্ছতা প্রয়োজন।

অসুবিধা |
ভূগর্ভস্থ জল দূষণের ঝুঁকি |	ভূমিকম্পের ঝুঁকি |	বায়ু দূষণ |	জলের অতিরিক্ত ব্যবহার |	স্বাস্থ্য ঝুঁকি |

উপসংহার

ফ্র্যাকিং একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়। এটি শক্তি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে এর পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাবগুলি উপেক্ষা করা যায় না। ফ্র্যাকিংয়ের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন এবং বাজারের চাহিদার উপর। এই বিষয়ে আরও গবেষণা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে এর সুবিধাগুলো কাজে লাগানো যায় এবং ঝুঁকিগুলো কমানো যায়।

যদি ফ্র্যাকিং সম্পর্কিত আরও নির্দিষ্ট বিষয়শ্রেণী প্রয়োজন হয়, তবে নিম্নলিখিতগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ