আব্বাসীয় খিলাফত
আব্বাসীয় খিলাফত
আব্বাসীয় খিলাফত ছিল মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের হাতে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে শাসন করে। এই সময়কালে ইসলামিক সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন এবং শিল্পকলায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। আব্বাসীয় খিলাফত শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত ছিল।
প্রতিষ্ঠা ও পটভূমি
আব্বাসীয়দের উত্থান শিয়া মুসলিমদের মধ্যে থেকে। আব্বাসীয়রা প্রফেট মুহাম্মদের চাচা আব্বাস ইবনে আবদুলমুত্তালিবের বংশধর ছিলেন। উমাইয়া খিলাফতের শাসনামলে বিভিন্ন কারণে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়, বিশেষ করে আরব ব্যতীত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার অভিযোগ ছিল। এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে আব্বাসীয়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে কূফার যুদ্ধে উমাইয়াদের পরাজিত করে খিলাফত দখল করে নেয়। আব্বাসীয়দের এই বিপ্লব ছিল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্র দামেস্ক থেকে ব্যাগদাদে স্থানান্তরিত হয়।
আব্বাসীয় খিলাফতের সোনালী যুগ
আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম কয়েক শতাব্দী ছিল স্বর্ণযুগ নামে পরিচিত। এই সময়ে ব্যাগদাদ বিশ্বের অন্যতম প্রধান শহর হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। হারুন আল-রশিদ (৭৮৬-৮০৯) এবং আল-মামুন (৮১৩-৮৩৩) এর মতো খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি হয়।
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: আব্বাসীয় বিজ্ঞানীরা গণিত, astronomy, চিকিৎসা এবং রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আল-খুয়ারিজমি বীজগণিতের জনক হিসেবে পরিচিত, এবং তার কাজ পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ইবনে সিনা (আভিসেনা) রচিত ‘কানুন আল-তিব’ (The Canon of Medicine) মধ্যযুগে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি আদর্শ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হত।
- দর্শন ও সাহিত্য: এই সময়ে গ্রিক দর্শনের অনুবাদ ও চর্চা শুরু হয়, যা ইসলামিক দর্শনের বিকাশে সহায়ক হয়। আল-কিন্দি, আল-ফারাবি এবং ইবনে রুশদ ছিলেন এই যুগের প্রভাবশালী দার্শনিক। ফার্সি সাহিত্য এবং আরবি কবিতা এই সময়ে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। আল-আসমাঈ, আবু নুয়াস এবং আল-মুতানাব্বি ছিলেন বিখ্যাত কবি।
- শিল্পকলা ও স্থাপত্য: আব্বাসীয় স্থাপত্যে পারস্য ও মেসোপটেমিয়ার প্রভাব দেখা যায়। ব্যাগদাদের গোল্ডেন গেট এবং সামাররার বিশাল মসজিদগুলি এর উজ্জ্বল উদাহরণ। ইসলামিক শিল্পকলায় ক্যালিগ্রাফি, জ্যামিতিক নকশা এবং মোজাইক শিল্পের বিকাশ ঘটে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
আব্বাসীয় খিলাফতের অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক, তবে বাণিজ্য এবং শিল্পকলারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
- কৃষি: মেসোপটেমিয়ার উর্বর ভূমি এবং উন্নত সেচ ব্যবস্থা কৃষিকাজের জন্য অনুকূল ছিল। ধান, আটা, ফল এবং সবজি প্রধান ফসল হিসেবে উৎপাদিত হত।
- বাণিজ্য: আব্বাসীয় খিলাফত পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপন করে। ব্যাগদাদ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে বণিকরা আসত। Silk Road (সিল্ক রোড) বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- মুদ্রা ও ব্যাংকিং: আব্বাসীয়রা স্বর্ণমুদ্রা (dinar) এবং রূপামুদ্রা (dirham) চালু করে, যা বাণিজ্যিক লেনদেন সহজ করে। এই সময়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রাথমিক রূপও দেখা যায়।
রাজনৈতিক কাঠামো
আব্বাসীয় খিলাফতের রাজনৈতিক কাঠামো ছিল বেশ জটিল। খলিফা ছিলেন সর্বোচ্চ শাসক, তবে সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন vizier (উজির), governor (শাসক) এবং judge (বিচারক) নিযুক্ত করা হত।
- কেন্দ্রীয় প্রশাসন: খলিফা ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান এবং সামরিক ও ধর্মীয় বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন। উজির ছিলেন খলিফার প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রশাসনিক কার্যাবলী পরিচালনা করতেন।
- প্রাদেশিক প্রশাসন: সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল, এবং প্রতিটি প্রদেশের শাসনভার একজন গভর্নরের উপর ন্যস্ত থাকত। গভর্নররা খলিফার নির্দেশে প্রদেশ পরিচালনা করতেন এবং রাজস্ব সংগ্রহ করতেন।
- সামরিক ব্যবস্থা: আব্বাসীয় খিলাফতের সামরিক শক্তি ছিল বিশাল। তুর্কি এবং আফ্রিকান দাসদের নিয়ে গঠিত সামরিক বাহিনী সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত।
পতন ও বিভাজন
নবম শতাব্দীর পর থেকে আব্বাসীয় খিলাফতের দুর্বলতা শুরু হয়। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, প্রাদেশিক governors-দের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং শিয়া ও সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেয়।
- রাজনৈতিক বিভাজন: আব্বাসীয় খিলাফতের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় dynasty-গুলো (যেমন তাহিরিদ, সাফারিদ, সামানিদ) নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে।
- অর্থনৈতিক সংকট: ক্রমাগত যুদ্ধ এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। রাজস্ব কমে যাওয়ায় সৈন্যদের বেতন দিতে সমস্যা হত।
- বহিরাগত আক্রমণ: কার্মাতিয়ান এবং বুয়িহিদদের মতো বিভিন্ন বহিরাগত শক্তির আক্রমণ আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
- ফাতেমীয় খিলাফত: ফাতেমীয় খিলাফত (৯১০-১১২১) আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং মিশর ও উত্তর আফ্রিকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
- সেলজুক তুর্কি: সেলজুক তুর্কিরা ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ দখল করে নেয় এবং আব্বাসীয় খলিফাদের puppet ruler (নিয়ন্ত্রিত শাসক)-এ পরিণত করে।
- মোঙ্গল আক্রমণ: ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হুলagu খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনী বাগদাদ আক্রমণ করে এবং খলিফা আল-মুসতাসিমকে হত্যা করে। এর ফলে আব্বাসীয় খিলাফতের অবসান হয়।
আব্বাসীয় খিলাফতের প্রভাব
আব্বাসীয় খিলাফত মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে এক গভীর প্রভাব ফেলে গেছে।
- জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ: আব্বাসীয় যুগে বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য এবং শিল্পকলায় যে উন্নতি সাধিত হয়েছিল, তা পরবর্তীকালে ইউরোপের রেনেসাঁর (Renaissance) পথ খুলে দিয়েছিল।
- সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: আব্বাসীয়রা আরবি ভাষাকে সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং ইসলামিক সংস্কৃতিকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়।
- রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো: আব্বাসীয়দের প্রশাসনিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক ধারণা পরবর্তী মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর জন্য অনুসরণীয় আদর্শ ছিল।
- অর্থনৈতিক সম্পর্ক: আব্বাসীয় খিলাফত বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসে।
টেবিল: আব্বাসীয় খলিফাদের তালিকা (কিছু উল্লেখযোগ্য)
| খলিফা | সময়কাল | |
|---|---|---|
| আবু আল-আব্বাস আস-সফাহ | ৭৫0-৭৫৪ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মনসুর | ৭৫৪-৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ | |
| হারুন আল-রশিদ | ৭৮৬-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মামুন | ৮১৩-৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুতাসিম | ৮৩৩-৮৪০ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-ওয়াসিক | ৮৪০-৮৪২ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুতাওয়াক্কিল | ৮৪২-৮৬১ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুয়তাজিদ | ৮৬৯-৮৯২ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুকতাদির | ৮৯২-৯০৮ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুতাযিদ | ৯০৮-৯৩২ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুস্তাকফি | ৯৩২-৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুতি | ৯৪৬-৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-তায়ি | ৯৭৪-৯৯১ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-কাদির | ৯৯১-১০৩২ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-কাইম | ১০৩২-১০৩৪ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুস্তানসির | ১০৩৪-১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুস্তাজহির | ১০৯৫-১১১৮ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-ফাদেল | ১১১৮-১১২০ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুস্তার্শিদ | ১১১৮-১১৮০ খ্রিস্টাব্দ | |
| আল-মুসতাসিম | ১১৮০-১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ |
আরও জানতে:
- ইসলামের ইতিহাস
- উমাইয়া খিলাফত
- ব্যাগদাদ
- হারুন আল-রশিদ
- আল-মামুন
- ইবনে সিনা
- আল-খুয়ারিজমি
- ফাতেমীয় খিলাফত
- সেলজুক সাম্রাজ্য
- মোঙ্গল সাম্রাজ্য
বাইনারি অপশন ট্রেডিং সম্পর্কিত লিঙ্ক:
১. বাইনারি অপশন বেসিক ২. টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস ৩. ভলিউম অ্যানালাইসিস ৪. ট্রেডিং স্ট্র্যাটেজি ৫. ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ৬. মানি ম্যানেজমেন্ট ৭. অপশন চেইন ৮. ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন ৯. মুভিং এভারেজ ১০. আরএসআই (RSI) ১১. এমএসিডি (MACD) ১২. বলিঙ্গার ব্যান্ড ১৩. ফিবোনাচি রিট্রেসমেন্ট ১৪. বাইনারি অপশন প্ল্যাটফর্ম ১৫. ডেমো অ্যাকাউন্ট
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
