মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস

সূচনা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আমেরিকার একটি দেশ। এর ইতিহাস বৈচিত্র্যময় এবং জটিল। স্থানীয় আমেরিকানদের বসতি স্থাপনের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয় এবং পরবর্তীতে ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর বিশ্বশক্তিতে পরিণত হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এই নিবন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রধান পর্যায়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

উপনিবেশ স্থাপন (১৬০৭-১৭৭৫)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের যুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। ১৬০৭ সালে জেমস্টাউন, ভার্জিনিয়ায় প্রথম স্থায়ী ইংরেজি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৬২০ সালে প্লিমাউথ কলোনি প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতাseeking তীর্থযাত্রীরা বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে, আটলান্টিক উপকূলের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ এবং ডাচ উপনিবেশগুলো বিস্তার লাভ করে।

উপনিবেশগুলোর বৈশিষ্ট্য

নতুন ইংল্যান্ড কলোনি (ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, নিউ হ্যাম্পশায়ার): এই অঞ্চলটি ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাণিজ্য এবং ছোট আকারের খামারভিত্তিক অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
মধ্যবর্তী কলোনি (নিউ ইয়র্ক, পেনসিলভানিয়া, নিউ জার্সি, ডেলাওয়্যার): এই কলোনিগুলো কৃষি, বাণিজ্য এবং শিল্প – এই তিনটি খাতেই উন্নতি লাভ করে।
দক্ষিণ কলোনি (ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড, নর্থ ক্যারোলিনা, সাউথ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া): এই অঞ্চলটি মূলত বৃহৎ আকারের প্ল্যান্টেশন অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল ছিল, যেখানে দাসপ্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।

উপনিবেশগুলোতে ধীরে ধীরে নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো তৈরি হতে থাকে। তবে, ব্রিটিশ সরকার থেকে বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করা হতে থাকে, যা উপনিবেশবাদীদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দেয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮৩)

ব্রিটিশ সরকারের কঠোর নীতি এবং কর আরোপের ফলে উপনিবেশবাদীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। "নো ট্যাক্সেশন উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশন" – এই স্লোগানকে কেন্দ্র করে বোস্টন টি পার্টির মতো ঘটনা ঘটে। ফলস্বরূপ, ১৭৭৫ সালে আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ শুরু হয়।

যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই, থমাস জেফারসন কর্তৃক রচিত স্বাধীনতা ঘোষণা (Declaration of Independence) প্রকাশিত হয়।
জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে কন্টিনেন্টাল আর্মি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
১৭৮১ সালে यॉर्कটাউনের যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান হয়।
১৭৮৩ সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা স্বীকৃতি পায়।

সংবিধান প্রণয়ন ও প্রাথমিক বছর (১৭৮৭-১৮৬০)

স্বাধীনতা লাভের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়াতে একটি সাংবিধানিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এই সংবিধানের মাধ্যমে একটি ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোর মধ্যে বিভক্ত থাকে।

সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য

ক্ষমতা পৃথকীকরণ: আইন, বিচার ও নির্বাহী – এই তিনটি branch-এর মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো: কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন করা হয়।
মৌলিক অধিকার: নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সমাবেশের অধিকার ইত্যাদি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
বিল অফ রাইটস: সংবিধানে প্রথম দশটি সংশোধনী, যা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষা করে।

১৮০০-এর দশকের প্রথম কয়েক দশকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা দিকে নিজেদের বিস্তার শুরু করে। এই সময়কালে লুইসিয়ানা ক্রয় (Louisiana Purchase) এবং ফ্লোরিডা ক্রয় (Florida Purchase)-এর মাধ্যমে দেশটির আয়তন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

গৃহযুদ্ধ ও পুনর্গঠন (১৮৬১-১৮৭৭)

দাসপ্রথা এবং রাজ্যগুলোর অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে ১৮৬১ সালে আমেরিকান গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন এই সময়কালের প্রেসিডেন্ট।

গৃহযুদ্ধের কারণ

দাসপ্রথা: দক্ষিণের অর্থনীতি দাসপ্রথার উপর নির্ভরশীল ছিল, অন্যদিকে উত্তরের রাজ্যগুলো দাসপ্রথার বিলোপ চেয়েছিল।
রাজ্যগুলোর অধিকার: দক্ষিণের রাজ্যগুলো মনে করত তাদের নিজেদের আইন তৈরি করার অধিকার আছে, যা কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের বাইরে থাকা উচিত।
অর্থনৈতিক পার্থক্য: উত্তর ও দক্ষিণের অর্থনীতির মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য ছিল।

১৮৬৫ সালে উত্তরের বিজয়ের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের অবসান হয় এবং দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা হয়। এরপর পুনর্গঠন যুগ শুরু হয়, যেখানে দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে আবার ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করা এবং আফ্রিকান আমেরিকানদের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়।

শিল্পায়ন ও প্রগতিশীল যুগ (১৮৭০-১৯২০)

গৃহযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত শিল্পায়ন শুরু হয়। রেলপথের বিস্তার, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং অভিবাসনের ফলে অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। এই সময়কালে জন ডি রকফেলার, অ্যান্ড্রু কার্নেগি এবং জে. পি. মরগান-এর মতো শিল্পপতিরা বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।

প্রগতিশীল আন্দোলনের মূল বিষয়

রাজনৈতিক সংস্কার: দুর্নীতি দূরীকরণ, ভোটাধিকারের প্রসার এবং জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি।
সামাজিক ন্যায়বিচার: শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, দরিদ্রদের সহায়তা এবং বৈষম্য হ্রাস।
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং ন্যায্য বাণিজ্য নিশ্চিত করা।

মহাভাব ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯২৯-১৯৪৫)

১৯২৯ সালে ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ-এর মাধ্যমে মহামন্দা শুরু হয়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট-এর নিউ ডিল (New Deal) কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে নিরপেক্ষ থাকলেও পার্ল হারবার আক্রমণের পর মিত্রশক্তির পক্ষে যোগদান করে। ডায়-ডে (D-Day) এবং হিরোশিমা ও নাগাসাকি-তে পারমাণবিক বোমা হামলার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান হয়।

যুদ্ধ-পরবর্তী যুগ ও ঠান্ডা যুদ্ধ (১৯৪৫-১৯৯১)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ঠান্ডা যুদ্ধ (Cold War) শুরু হয়, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এই সময়কালে কোরীয় যুদ্ধ (Korean War) এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ (Vietnam War)-এর মতো বড় ধরনের সংঘাত হয়।

গৃহ অধিকার আন্দোলন

১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর নেতৃত্বে গৃহ অধিকার আন্দোলন (Civil Rights Movement) শুরু হয়, যার লক্ষ্য ছিল আফ্রিকান আমেরিকানদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

একবিংশ শতাব্দী (২০০১-বর্তমান)

একবিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১ হামলার শিকার হয়, যা দেশটির নিরাপত্তা নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। আফগানিস্তান ও ইরাক-এ যুদ্ধ শুরু হয়। এই সময়কালে বারাক ওবামা প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

বর্তমানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ। তবে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো দেশটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।

টেবিল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের তালিকা (প্রথম দশজন)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দশজন প্রেসিডেন্ট
ক্রমিক নং	নাম	কার্যকাল	রাজনৈতিক দল
১	জর্জ ওয়াশিংটন	১৭৮৯-১৭৯৭	কোনো দল নেই
২	জন অ্যাডামস	১৭৯৭-১৮০১	ফেডারেলিস্ট পার্টি
৩	থমাস জেফারসন	১৮০১-১৮০৯	ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান পার্টি
৪	জেমস ম্যাডিসন	১৮০৯-১৮১৭	ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান পার্টি
৫	জেমস মনরো	১৮১৭-১৮২৫	ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান পার্টি
৬	জন কুইন্সি অ্যাডামস	১৮২৫-১৮২৯	ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান পার্টি
৭	অ্যান্ড্রু জ্যাকসন	১৮২৯-১৮৩৭	ডেমোক্রেটিক পার্টি
৮	মার্টিন ভ্যান Buren	১৮৩৭-১৮৪১	ডেমোক্রেটিক পার্টি
৯	উইলিয়াম হেনরি Harrison	১৮৪১	হুইগ পার্টি
১০	জন Tyler	১৮৪১-১৮৪৫	হুইগ পার্টি

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

Zinn, Howard. *A People's History of the United States*. New York: Harper Perennial Modern Classics, 2003.
Brands, H.W. *American Colossus: The Triumph of Capitalism, 1865-1900*. New York: Doubleday, 2010.
McCullough, David. *1776*. New York: Simon & Schuster, 2001.

বাহ্যিক লিঙ্ক

[The White House](https://www.whitehouse.gov/)
[National Archives](https://www.archives.gov/)
[Library of Congress](https://www.loc.gov/)

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ