কোরীয় যুদ্ধ

কোরীয় যুদ্ধ ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংঘাত, যা ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধ ঠান্ডা যুদ্ধ-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এবং এটি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটায়। এই নিবন্ধে কোরীয় যুদ্ধের কারণ, ঘটনা, ফলাফল এবং এর তাৎপর্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

পটভূমি

কোরীয় উপদ্বীপের ইতিহাস বহু প্রাচীনকাল থেকে চীন ও জাপান-এর প্রভাবের অধীনে ছিল। ১৯১০ সালে জাপান কোরিয়াকে সম্পূর্ণরূপে দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পণের পর কোরিয়া দুটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায়: উত্তর কোরিয়া, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন-সমর্থিত কিম ইল-সুং-এর কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং দক্ষিণ কোরিয়া, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সিঙ্গম্যান রি-এর সরকার গঠিত হয়। উভয় সরকারই সমগ্র কোরিয়ার উপর নিজেদের অধিকার দাবি করতে থাকে, যা উপদ্বীপে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

যুদ্ধের কারণ

কোরীয় যুদ্ধের মূল কারণগুলো হলো:

কোরিয়ার বিভাজন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়ার দুটি অঞ্চলে বিভাজন এবং উভয় অংশের ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের সংঘাত যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল।
কিম ইল-সুং-এর উদ্দেশ্য: উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল-সুং কোরিয়াকে কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন এবং এর জন্য সামরিক পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী ছিলেন।
ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব: যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোরীয় উপদ্বীপে প্রভাব ফেলে এবং উভয় দেশই নিজ নিজ পছন্দের সরকারকে সমর্থন করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি: যুক্তরাষ্ট্রের ‘দূরণীয় প্রতিরোধ’ (Containment Policy) নীতি অনুসারে, কমিউনিস্টদের বিস্তার রোধ করতে তারা দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করে।

যুদ্ধের সূচনা ও বিস্তার

১৯৫০ সালের ২৫ জুন, উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার উপর আকস্মিক হামলা চালায়। উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী দ্রুত অগ্রসর হয়ে সিউল দখল করে নেয় এবং দক্ষিণ কোরীয় সৈন্যদের পিছু হটতে বাধ্য করে। জাতিসংঘ দ্রুত হস্তক্ষেপ করে এবং উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি জাতিসংঘ বাহিনী গঠিত হয়, যাতে বিভিন্ন দেশের সৈন্য অংশগ্রহণ করে।

কোরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রধান দেশসমূহ
দেশ	পক্ষ		যুক্তরাষ্ট্র	জাতিসংঘ বাহিনী		সোভিয়েত ইউনিয়ন	উত্তর কোরিয়া		চীন	উত্তর কোরিয়া		যুক্তরাজ্য	জাতিসংঘ বাহিনী		কানাডা	জাতিসংঘ বাহিনী		অস্ট্রেলিয়া	জাতিসংঘ বাহিনী		তুরস্ক	জাতিসংঘ বাহিনী		ফিলিপাইন	জাতিসংঘ বাহিনী		দক্ষিণ কোরিয়া	জাতিসংঘ বাহিনী		উত্তর কোরিয়া	কমিউনিস্ট বাহিনী

যুদ্ধের পর্যায়

কোরীয় যুদ্ধকে কয়েকটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়:

প্রথম পর্যায় (১৯৫০): উত্তর কোরিয়ার আকস্মিক আক্রমণ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পতন। জাতিসংঘ বাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং ইঞ্চিওন অবতরণ (Inchon Landing)।
দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৫০-১৯৫১): জাতিসংঘ বাহিনী উত্তর কোরিয়াকে ইয়ালু নদী পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য করে। চীনের হস্তক্ষেপ এবং জাতিসংঘ বাহিনীর পুনরায় পিছু হটা।
তৃতীয় পর্যায় (১৯৫১-১৯৫৩): যুদ্ধ স্থিতিশীল অবস্থায় আসে এবং উভয় পক্ষ ট্রেঞ্চ warfare-এ লিপ্ত হয়। যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু হয়, কিন্তু কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।

ইঞ্চিওন অবতরণ

ডগলাস ম্যাকআর্থার-এর পরিকল্পনায় ১৯৫০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইঞ্চিওন বন্দরে জাতিসংঘ বাহিনীর অবতরণ ছিল যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই আকস্মিক আক্রমণে উত্তর কোরিয়ার সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং জাতিসংঘ বাহিনী দ্রুত উত্তর দিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়।

চীনের হস্তক্ষেপ

১৯৫০ সালের নভেম্বরে চীন কোরীয় যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। চীনের বিশাল সংখ্যক সৈন্য উত্তর কোরিয়ার সমর্থনে যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দেয় এবং জাতিসংঘ বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। চীনের হস্তক্ষেপ যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয় এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়।

যুদ্ধবিরতি ও ফলাফল

১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা কোরীয় যুদ্ধকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত করে। এই চুক্তির মাধ্যমে কোরিয়া উপদ্বীপকে প্রায় একই স্থানে বিভক্ত রাখা হয়, যা যুদ্ধের আগে ছিল। তবে, কোনো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি, যার ফলে দুই কোরিয়ার মধ্যে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে।

কোরীয় যুদ্ধের ফলাফল ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী:

কোরিয়ার বিভাজন: কোরিয়া দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়: উত্তর কোরিয়া (গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া) এবং দক্ষিণ কোরিয়া (কোরিয়া প্রজাতন্ত্র)।
জীবনহানি: যুদ্ধে আনুমানিক প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, যার মধ্যে সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিক উভয়ই ছিল।
অর্থনৈতিক ধ্বংস: কোরীয় উপদ্বীপের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
ঠান্ডা যুদ্ধের তীব্রতা: কোরীয় যুদ্ধ ঠান্ডা যুদ্ধের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং ন্যাটো ও ওয়ারশ জোট-এর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করে।
সামরিক জোট: যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সামরিক জোট গঠিত হয়, যা পরবর্তীতে সিটো (SEATO) এবং সেন্টো (CENTO) নামে পরিচিত হয়।

কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত দিক

কোরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ও প্রযুক্তি ছিল:

ট্যাঙ্ক যুদ্ধ: উভয় পক্ষই ব্যাপকভাবে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে। এম-২৬ পারশিং (M-26 Pershing) এবং টি-৩৪ (T-34) ট্যাংকগুলো যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
বিমান সহায়তা: যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী উত্তর কোরিয়ার উপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায় এবং দক্ষিণ কোরীয় সৈন্যদের সহায়তা করে। এফ-৮৬ সেবার (F-86 Sabre) এবং মিগ-১৫ (MiG-15) যুদ্ধবিমানগুলো আকাশযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আর্টিলারি ও মর্টার: উভয় পক্ষই আর্টিলারি ও মর্টার ব্যবহার করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
গেরিলা যুদ্ধ: উত্তর কোরিয়ার গেরিলারা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে গেরিলা কার্যক্রম চালায়।

ভলিউম বিশ্লেষণ

কোরীয় যুদ্ধে ভলিউম বিশ্লেষণের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। উভয় পক্ষই সৈন্যদের সংখ্যা, অস্ত্রের সরবরাহ এবং রসদ সরবরাহের উপর নির্ভর করে তাদের কৌশল নির্ধারণ করত।

সৈন্যের মোতায়েন: উত্তর কোরিয়া শুরুতে প্রায় ৮৫,০০০ সৈন্য নিয়ে আক্রমণ শুরু করে, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫,০০০। জাতিসংঘ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এক সময়ে প্রায় ৫ লক্ষ সৈন্য কোরিয়ায় মোতায়েন করা হয়।
সরবরাহ ব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত সরবরাহ ব্যবস্থা জাতিসংঘ বাহিনীকে প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করতে সহায়তা করে। চীনের দীর্ঘ সরবরাহ লাইন ছিল দুর্বল, যা তাদের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে।
লজিস্টিক পরিকল্পনা: কার্যকর লজিস্টিক পরিকল্পনা যুদ্ধের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জাতিসংঘ বাহিনী এই ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া ও চীনের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ছিল।

যুদ্ধের তাৎপর্য

কোরীয় যুদ্ধ ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংঘাত। এটি প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রভাব বলয় রক্ষার জন্য যেকোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত ছিল। এই যুদ্ধ জাতিসংঘ-এর ক্ষমতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। কোরীয় যুদ্ধের অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংঘাতের উপর প্রভাব ফেলে।