আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা
ভূমিকা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labour Organization - ILO) হলো জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা। এটি ১৯১৯ সালে গঠিত হয় এবং ১৯৪৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সাথে যুক্ত। আইএলও-র মূল লক্ষ্য হলো শ্রমিক অধিকার রক্ষা করা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা, এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা। এটি আন্তর্জাতিক শ্রম মান নির্ধারণ করে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এই মানগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করে। আইএলও বিশ্বের সকল সদস্য রাষ্ট্রের সরকার, নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিকদের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় ফোরাম হিসেবে কাজ করে।
প্রতিষ্ঠা ও পটভূমি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রম সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সংস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির অংশ হিসেবে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা। প্রথম দিকে, আইএলও মূলত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়। জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর আইএলও-র কর্মপরিধি আরও বৃদ্ধি পায়।
উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী আইএলও-র প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:
- শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা: ন্যূনতম মজুরি, কাজের সময়সীমা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং সংগঠনের স্বাধীনতা সহ শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা।
- কর্মসংস্থান বৃদ্ধি: পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা।
- সামাজিক সুরক্ষা: বেকারত্ব ভাতা, স্বাস্থ্য বীমা, এবং পেনশনসহ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা।
- আন্তর্জাতিক শ্রম মান নির্ধারণ: শ্রমিক অধিকার এবং কর্মসংস্থান সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মানের প্রবর্তন ও প্রচার করা।
- প্রযুক্তিগত সহায়তা: সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে শ্রম আইন এবং নীতি প্রণয়নে সহায়তা করা।
- পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ: শ্রমবাজারের তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা।
সাংগঠনিক কাঠামো আইএলও-র সাংগঠনিক কাঠামো তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত:
১. আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলন (International Labour Conference): এটি আইএলও-র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী অঙ্গ। প্রতি বছর জুন মাসে জেনেভাতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সরকার, নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন এবং আন্তর্জাতিক শ্রম মান প্রণয়ন করেন।
২. পরিচালনা পর্ষদ (Governing Body): এটি আইএলও-র নির্বাহী অঙ্গ। পরিচালনা পর্ষদে সরকার, নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত থাকেন। এটি সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করে এবং সংস্থার দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করে।
৩. আন্তর্জাতিক শ্রম কার্যালয় (International Labour Office): এটি আইএলও-র সচিবালয়। জেনেভাতে অবস্থিত এই কার্যালয়টি সংস্থার প্রশাসনিক ও কারিগরি কার্যক্রম পরিচালনা করে। মহাপরিচালক এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
আইএলও-র গুরুত্বপূর্ণ কনভেনশনসমূহ আইএলও বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক অধিকার এবং কর্মসংস্থান সম্পর্কিত অসংখ্য কনভেনশন (Convention) ও সুপারিশ (Recommendation) গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো:
- কনভেনশন নং ৮৭: সংগঠনের স্বাধীনতা এবং সমাবেশ করার অধিকার।
- কনভেনশন নং ৯৮: সমঝোতা করার অধিকার।
- কনভেনশন নং ২৯: বাধ্যতামূলক শ্রম বিলোপ।
- কনভেনশন নং ১০০: সম মজুরির অধিকার।
- কনভেনশন নং ১১১: কর্মসংস্থান এবং বৈষম্য বিলোপ।
- কনভেনশন নং ১৩৮: ন্যূনতম বয়স (কর্মসংস্থান)।
- কনভেনশন নং ১৮২: শিশু শ্রমের Worst Forms বিলোপ।
আইএলও-র কার্যক্রম এবং প্রভাব আইএলও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রম অধিকার এবং কর্মসংস্থান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংস্থাটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে শ্রম আইন সংস্কার, কর্মসংস্থান নীতি প্রণয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে সহায়তা করে। আইএলও-র কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে অনেক উন্নয়নশীল দেশ তাদের শ্রমবাজারের আধুনিকীকরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
এছাড়াও, আইএলও বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রমবাজারের গতিবিধি এবং চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করে। এই গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলো নীতি নির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়। আইএলও-র উদ্যোগে গ্লোবাল কমিশন অন ফিউচার অফ ওয়ার্ক (Global Commission on the Future of Work) গঠিত হয়েছে, যা কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ করছে।
বাণিজ্য এবং শ্রম অধিকারের মধ্যে সম্পর্ক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং শ্রম অধিকারের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক বিদ্যমান। বিশ্বায়ন এবং মুক্ত বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আইএলও মনে করে, বাণিজ্য উদারীকরণ শ্রমিকদের শোষণ ও বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে, যদি না উপযুক্ত শ্রম মান নিশ্চিত করা হয়।
এজন্য, আইএলও বাণিজ্য চুক্তিগুলোতে শ্রম অধিকারের বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দেয়। সংস্থাটি মনে করে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা হলে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
চ্যালেঞ্জসমূহ আইএলও বর্তমানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
- বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব সমস্যা: বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা একটি উদ্বেগের বিষয়।
- নিয়মিত কর্মসংস্থান হ্রাস: অস্থায়ী ও স্বল্পমেয়াদী কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা কমে যাচ্ছে।
- বৈষম্য: শ্রমবাজারে নারী, সংখ্যালঘু এবং অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য এখনো বিদ্যমান।
- জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কর্মসংস্থান এবং জীবিকা নির্বাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
- ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব: অটোমেশন এবং ডিজিটালাইজেশনের কারণে অনেক কাজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যা নতুন কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আইএলও ভবিষ্যতের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- শোভন কর্মসংস্থান তৈরি: সকলের জন্য শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা, যেখানে শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং সামাজিক সুরক্ষা ভোগ করতে পারবে।
- দক্ষতা উন্নয়ন: শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা, যাতে তারা পরিবর্তিত শ্রমবাজারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
- সামাজিক সংলাপ: সরকার, নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে শ্রম সমস্যা সমাধান করা।
- প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন: প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা এবং শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।
- টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন: ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals - SDGs) অর্জনে সহায়তা করা, বিশেষ করে SDG 8 (শোভন কাজ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি)।
আইএলও-র সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়
- শ্রম আইন
- কর্মসংস্থান নীতিমালা
- সামাজিক নিরাপত্তা
- দারিদ্র্য বিমোচন
- মানবাধিকার
- জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা
উপসংহার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার রক্ষা এবং কর্মসংস্থান উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সংস্থাটি শ্রমিক, নিয়োগকর্তা এবং সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংলাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রম মান নির্ধারণ করে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এই মানগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করে। তবে, বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব, বৈষম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে আইএলও-কে আরও সক্রিয় ও উদ্ভাবনী হতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য গৃহীত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে আইএলও একটি উন্নত ও ন্যায়সংগত কর্মসংস্থান ব্যবস্থা তৈরি করতে সহায়ক হবে।
আরও তথ্যের জন্য:
বিষয়শ্রেণী:
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
