মানব ইতিহাস

মানব ইতিহাস হলো হোমিনিনদের (মানুষ এবং তাদের বিলুপ্ত পূর্বপুরুষ) পৃথিবীতে আবির্ভাব এবং বিকাশ লাভের বৃত্তান্ত। প্রায় ৩০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায় প্রথম হোমিনিরা উদ্ভূত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এরপর তারা ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং জটিল সমাজ, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি তৈরি করে। মানব ইতিহাসকে সাধারণত তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা হয়: প্রাগৈতিহাসিক যুগ, প্রাচীন যুগ এবং মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ

প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলতে মানব ইতিহাসের সেই সময়কালকে বোঝায়, যার কোনো লিখিত records নেই। এই যুগকে আবার তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়:

পুরাতন প্রস্তর যুগ (প্রায় ৩০ লক্ষ বছর আগে - ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): এই সময়ে হোমো হাবিলিস ও হোমো ইরেক্টাস-এর মতো আদিম মানুষেরা পাথর ও হাড়ের সরঞ্জাম ব্যবহার করত। তারা শিকার, ফল সংগ্রহ এবং যাযাবর জীবনযাপন করত। লাস্কক্স গুহাচিত্র এই যুগের শিল্পকলার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।

মধ্য প্রস্তর যুগ (প্রায় ১০,০০০ - ৮,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): এই সময়ে হোমো সেপিয়েন্স-রা আরও উন্নত হাতিয়ার তৈরি করতে শুরু করে এবং কৃষির প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবেশ করে। মেসোলিথিক সংস্কৃতি এই সময়ের জীবনযাত্রার প্রতিফলন ঘটায়।

নব্য প্রস্তর যুগ (প্রায় ৮,০০০ - ৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): এই সময়ে কৃষি বিপ্লব ঘটে এবং মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। মাটির পাত্র তৈরি, পশুপালন এবং গ্রাম-এর উদ্ভব হয়। চায়ানাকায়া এবং জেরিহো এই যুগের গুরুত্বপূর্ণ বসতি ছিল।

প্রাচীন যুগ

প্রাচীন যুগ শুরু হয় লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবনের সাথে সাথে। এই যুগে বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে ওঠে এবং বিস্তার লাভ করে।

মিশরীয় সভ্যতা (প্রায় ৩,১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): নীল নদের তীরে এই সভ্যতা গড়ে ওঠে। পিরামিড, স্ফিংক্স এবং হায়রোগ্লিফিক লিপির জন্য মিশরীয় সভ্যতা বিখ্যাত। ফারعونরা ছিলেন এই সভ্যতার শাসক।

মেসোপটেমীয় সভ্যতা (প্রায় ৩,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই সভ্যতা গড়ে ওঠে। সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয় এবং কালদীয়রা এই অঞ্চলে শাসন করত। হাম্মুরাবির বিধি এই যুগের গুরুত্বপূর্ণ আইন সংকলন।

সিন্ধু সভ্যতা (প্রায় ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): সিন্ধু নদীর অববাহিকায় এই সভ্যতা গড়ে ওঠে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো ছিল এই সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র। উন্নত নগর পরিকল্পনা, পাকা রাস্তা ও নর্দমা ব্যবস্থা এই সভ্যতার বৈশিষ্ট্য।

গ্রিক সভ্যতা (প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ৬০০ খ্রিস্টাব্দ): ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এই সভ্যতা গড়ে ওঠে। গণতন্ত্র, দর্শন, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে গ্রিকদের অবদান উল্লেখযোগ্য। প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও সক্রেটিস ছিলেন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক। অলিম্পিক খেলা এই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

রোমান সভ্যতা (প্রায় ৭৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ): ইতালিতে এই সভ্যতা গড়ে ওঠে। সামরিক শক্তি, আইন ও প্রশাসনের জন্য রোমানরা পরিচিত ছিল। রোমান সাম্রাজ্য বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। জুলিয়াস সিজার ছিলেন বিখ্যাত রোমান সম্রাট।

মধ্যযুগ

প্রাচীন যুগের পতনের পর মধ্যযুগ শুরু হয়। এই সময়কালে ইউরোপে সামন্তবাদ এবং গির্জার প্রভাব ছিল প্রবল।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য (৩৪ খ্রিস্টাব্দ - ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ): রোমান সাম্রাজ্যর পূর্বাঞ্চল নিয়ে এই সাম্রাজ্য গঠিত হয়েছিল। কনস্টান্টিনোপল ছিল এর রাজধানী।

ইসলামিক সাম্রাজ্য (৬২২ খ্রিস্টাব্দ - ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ): ইসলাম ধর্মের প্রবর্তনের পর এই সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। আরবরা উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও স্পেন জয় করে।

ক্রুসেড (১০৯৬ খ্রিস্টাব্দ - ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ): খ্রিস্টানরা জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

রেনেসাঁ (১৪শ শতাব্দী - ১৬শ শতাব্দী): ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্যের পুনর্জাগরণ ঘটে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো ও রাফায়েল ছিলেন রেনেসাঁর বিখ্যাত শিল্পী।

আধুনিক যুগ

মধ্যযুগের পর আধুনিক যুগ শুরু হয়। এই সময়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসে।

আবিষ্কারের যুগ (১৪শ শতাব্দী - ১৭শ শতাব্দী): ইউরোপীয় নাবিকরা নতুন সাগরপথ আবিষ্কার করে এবং আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে।

শিল্প বিপ্লব (১৮শ শতাব্দী - ১৯শ শতাব্দী): ব্রিটেনে প্রথম যন্ত্রর ব্যবহার শুরু হয় এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে।

সাম্রাজ্যবাদ (১৯শ শতাব্দী - বিংশ শতাব্দী): ইউরোপীয় দেশগুলো আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করে।

বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ ও ১৯৩৯-১৯৪৫): দুটি মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনে।

ঠান্ডা যুদ্ধ (১৯৪7-১৯৯১): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করে।

বিশ্বায়ন (বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ - বর্তমান): যোগাযোগ, বাণিজ্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী interdependence বৃদ্ধি পায়।