ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন

ভূমিকা

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় জনগণের দীর্ঘ এবং জটিল সংগ্রাম। এই আন্দোলন উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক সংস্কার এবং বিপ্লবী কার্যকলাপের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। এই নিবন্ধে, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, নেতৃত্ব এবং কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ-এর মাধ্যমে ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। ধীরে ধীরে তারা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। কোম্পানির শাসনের অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক আধিপত্য ভারতীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং রায়তওয়ারী ব্যবস্থা, কৃষকদের নিঃস্ব করে তোলে। ভারতীয় শিল্প ও বাণিজ্য ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে স্থানীয় অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে।

এছাড়াও, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, যেমন সরকারি চাকরিতে সুযোগের অভাব এবং বিচার ব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব, জনগণের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। পশ্চিমা শিক্ষা এবং গণমাধ্যমের প্রভাবে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণী জাতীয়তাবাদের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হন এবং তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন।

প্রথম স্বাদেশিকতার উন্মেষ (১৮৫৭-১৯০৫)

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় ধরনের বিদ্রোহ। যদিও এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল, এটি ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে। এই বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতে প্রশাসনিক পরিবর্তন আনে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটায়। ভারত সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে আসে।

এই সময়ে, বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, যেমন ব্রাহ্ম সমাজ, আর্য সমাজ এবং রামকৃষ্ণ মিশন। এই আন্দোলনগুলো সমাজের কুসংস্কার দূর করতে এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রাথমিক রাজনৈতিক সংগঠন

১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল ভারতীয়দের প্রথম জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠন। কংগ্রেসের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকার আদায় এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে জনগণের দাবি জানানো। কংগ্রেসের প্রথম দিকের নেতারা, যেমন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং দাদাবাই নওরোজি, ছিলেন উদারপন্থী এবং তারা সাংবিধানিক উপায়ে ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতা করে রাজনৈতিক সংস্কার দাবি করতেন।

বিপ্লবী ও চরমপন্থী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১৭)

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি নতুন মোড় আসে। বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এর ফলস্বরূপ স্বাদেশিকতা আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়। বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিন চন্দ্র পাল এবং লালা লাজপত রায়-এর মতো নেতারা চরমপন্থী মতাদর্শের প্রচার করেন এবং স্বরাজ বা স্ব-শাসন দাবি করেন।

এই সময়ে, বিপ্লবী আন্দোলনও জোরদার হয়। অরবিন্দ ঘোষ, রাসবিহারী বসু এবং ভগত সিং-এর মতো বিপ্লবীরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। তারা বোমা তৈরি, ডাকাতি এবং অন্যান্য বিপ্লবী কার্যকলাপের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানান।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিদের তালিকা (১৮৮৫-১৯৪৭)
বছর	সভাপতি		১৮৮৫	উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়		১৮৮৬	দাদাবাই নওরোজি		১৮৮৭	বদরুদ্দিন তৈয়বজি		১৮৮৮	জর্জ ইউল		১৮৮৯	ফিরোজ শাহ মেহতা		১৯০৬	দাদাভাই নওরোজি (দ্বিতীয়বার)		১৯০৭	রাসবিহারী ঘোষ		১৯০৮	জ্ঞানেন্দ্রনাথ লাহিড়ী		১৯০৯	মধুসূদন বিশ্বাস		১৯১০	উইলিয়াম আর্চিবল্ড		১৯১১	রোমান্দাস রামচন্দ্র জানকার		১৯১২	রঙ্গাচারি চক্রবর্তী		১৯১৩	নিজামউদ্দিন আহমেদ		১৯১৪	ভীমাজি পারিখ		১৯১৫	সত্যেন্দ্র প্রসাদ সিনহা		১৯১৬	animations.অ্যানি বেসান্ত		১৯১৭	animations.মতী সরোজিনী নাইডু

গান্ধী যুগ (১৯১৭-১৯৪7)

১৯১৭ সালে মহাত্মা গান্ধী ভারতে ফিরে আসেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। গান্ধীজি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রবর্তন করেন, যা ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানায়। এই আন্দোলনের মধ্যে অবরোধ, বয়কট এবং সত্যাগ్రహ-এর মতো কৌশল অন্তর্ভুক্ত ছিল।

গান্ধীজির নেতৃত্বে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তিনি পূর্ণ স্বরাজ বা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন এবং ব্রিটিশ সরকারকে ভারত ত্যাগ করতে আহ্বান জানান। গান্ধীজির আন্দোলনের ফলে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক গ্রেপ্তার হন, কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের spirit অটুট থাকে।

গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও ঘটনা

**জallianwala Bagh হত্যাকাণ্ড (১৯১৯):** পাঞ্জাবের অমৃতসরে জাল্লিয়ানওয়ালা পার্কে ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিবর্ষণে hundreds of নিরীহ মানুষ নিহত হন। এই ঘটনা ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা আরও বাড়িয়ে দেয়।
**অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২):** গান্ধীজির নেতৃত্বে এই আন্দোলনে ভারতীয়রা সরকারি কাজকর্ম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি পণ্য বয়কট করেন।
**চৌরি-চৌরা ঘটনা (১৯২২):** উত্তর প্রদেশের চৌরি-চৌরা শহরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কয়েকজন পুলিশ অফিসার নিহত হন। এই ঘটনার পর গান্ধীজি আন্দোলন স্থগিত করেন।
**নাগরিক अवज्ञा আন্দোলন (১৯৩০-১৯৩৪):** গান্ধীজি লবণ সত্যাগ্রহের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূচনা করেন। ভারতীয়রা ব্রিটিশ সরকারের লবণ আইন ভঙ্গ করে লবণ তৈরি করে প্রতিবাদ জানান।
**ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২):** গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারকে ভারত ত্যাগ করার আহ্বান জানান। এই আন্দোলনের ফলে ব্যাপক ধরপাকড় হয় এবং বহু নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন।

নেতৃত্ব

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব অংশগ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন:

**মহাত্মা গান্ধী:** জাতির জনক হিসেবে পরিচিত গান্ধীজি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
**জওহরলাল নেহেরু:** ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি আধুনিক ভারতের ভিত্তি স্থাপন করেন।
**সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল:** ভারতের লৌহমানব হিসেবে পরিচিত, যিনি বিভিন্ন রাজ্যকে একত্রিত করে ভারতের সংহতি রক্ষা করেন।
**সুভাষচন্দ্র বসু:** একজন বিপ্লবী নেতা, যিনি ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
**ভগৎ সিং:** একজন বিপ্লবী, যিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেন এবং শহিদ হন।
** animations.মতী সরোজিনী নাইডু:** ভারতের কোকিল নামে পরিচিত, যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
**বিপিন চন্দ্র পাল:** একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক, যিনি জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগরণে সহায়তা করেন।

ফলাফল ও বিভাজন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা দিতে রাজি হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। তবে, স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথে partition-এর tragedy ঘটে, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং communal violence-তে বহু মানুষ প্রাণ হারান।

উপসংহার

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল ভারতীয় জনগণের অদম্য সাহস, ত্যাগ এবং সংগ্রামের ফল। এই আন্দোলন শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দেয়নি, বরং ভারতীয় সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এই আন্দোলনের শিক্ষা এবং আদর্শ আজও ভারতের ভবিষ্যৎ নির্মাণে সহায়ক।

আরও জানার জন্য:

কৌশল, টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণের জন্য:

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ