ভলতেয়ার

ভলতেয়ার : জীবন, দর্শন ও প্রভাব

ভূমিকা

ভলতেয়ার (Voltaire) ছিলেন ফরাসি আলোকিত যুগ-এর একজন প্রভাবশালী লেখক, ইতিহাসবিদ, দার্শনিক এবং যুক্তিবাদের অন্যতম প্রবক্তা। তাঁর আসল নাম ফ্রঁসোয়া-মারি আরুয়ে (François-Marie Arouet)। ভলতেয়ার ছদ্মনামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৭ শতাব্দীর শেষভাগ এবং ১৮ শতাব্দীর প্রথমভাগে ফরাসি সমাজে প্রচলিত পুরাতন তন্ত্র (Ancien Régime)-এর কঠোর সমালোচনা করেন এবং বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় সহনশীলতা, এবং আইনের শাসন-এর পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। ভলতেয়ারের কাজের গভীরতা এবং প্রভাব আজও বিদ্যমান, এবং তিনি পশ্চিমা রাজনৈতিক চিন্তা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হন।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

ভলতেয়ার ১৬৯৪ সালের ২১ নভেম্বর প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন আইনজীবী, এবং মা ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। তিনি জেসুইট কলেজে শিক্ষা গ্রহণ করেন, যেখানে তিনি সাহিত্য, ল্যাটিন এবং classiques বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। যদিও তিনি প্রথমে আইন পেশায় নিযুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর আগ্রহ ছিল সাহিত্য এবং লেখার দিকে।

সাহিত্যিক জীবন ও কর্ম

ভলতেয়ারের সাহিত্যিক জীবন নানা ধরনের রচনায় সমৃদ্ধ। তিনি কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে:

পয়েম অন দ্য ডিজাস্টার অ্যাট লিসবন (Poème sur le désastre de Lisbonne):: এটি ১৭৫৫ সালের লিসবন ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখা একটি দার্শনিক কবিতা, যেখানে তিনি ঈশ্বরের ন্যায়বিচার এবং মানব দুঃখভোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ক্যান্ডিড (Candide):: এটি ভলতেয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলির মধ্যে অন্যতম। এই উপন্যাসটি লাইবনিজের optimistic দর্শনের একটি ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা, যেখানে ক্যান্ডিড নামের এক যুবক জীবনের দুঃখ-কষ্টের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।
ফিলোসফিক্যাল ডিকশনারি (Dictionnaire philosophique):: এটি একটি বিশ্বকোষীয় রচনা, যেখানে ভলতেয়ার বিভিন্ন ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক বিষয় নিয়ে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন।
বয়জ অফ দ্য হিস্টোরি অফ চার্লস XII (Le Siècle de Louis XIV):: এটি ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালের ইতিহাস, যা ভলতেয়ারের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের একটি উদাহরণ।

দর্শন ও চিন্তাধারা

ভলতেয়ারের দর্শন মূলত যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের উপর ভিত্তি করে গঠিত। তিনি মনে করতেন, মানুষের জ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়, এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাস মানুষের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে। তাঁর দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

বাকস্বাধীনতা ও সহনশীলতা: ভলতেয়ার মনে করতেন, প্রত্যেক মানুষেরই নিজের চিন্তা ও মতামত প্রকাশের অধিকার থাকা উচিত। তিনি ধর্মীয় সহনশীলতার পক্ষে ছিলেন এবং সকল প্রকার ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করতেন।
ঈশ্বরের ধারণা: ভলতেয়ার প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণার সমালোচনা করেন। তিনি দেইস্ট (Deist) ছিলেন, অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু এরপর তিনি জগতের affaires-এ হস্তক্ষেপ করেন না।
প্রাকৃতিক আইন: ভলতেয়ার প্রাকৃতিক আইনের ধারণাকে সমর্থন করতেন, যা অনুসারে মানুষের কিছু সহজাত অধিকার রয়েছে, যা কোনো সরকার বা কর্তৃপক্ষের দ্বারা হরণ করা যায় না।
রাজনৈতিক সমালোচনা: ভলতেয়ার ফরাসি রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেন এবং জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে মত দেন।

রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও নির্বাসন

ভলতেয়ারের লেখালেখি এবং রাজনৈতিক মতামত ফরাসি সরকারের কাছে ক্ষতিকর বিবেচিত হওয়ায় তিনি বেশ কয়েকবার কারাবাস ও নির্বাসনের শিকার হন। তিনি ১৭২৬ সালে বাস্তিল দুর্গে বন্দী ছিলেন, এবং পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে নির্বাসিত হন। ইংল্যান্ডে তিনি প্রায় তিন বছর কাটান, যেখানে তিনি জন লক ও আইজ্যাক নিউটনের কাজের সাথে পরিচিত হন এবং তাঁর চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব গ্রহণ করেন।

ফরাসি বিপ্লবে ভলতেয়ারের প্রভাব

যদিও ভলতেয়ার ফরাসি বিপ্লব (French Revolution) দেখেননি (১৭৭৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়), তাঁর চিন্তা ও লেখা ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিপ্লবের নেতারা স্বাধীনতা, সাম্য, এবং ভ্রাতৃত্ব-এর নীতিগুলো গ্রহণ করেন, যা ভলতেয়ারের দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।