ব্রুন্টল্যান্ড কমিশন

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশন, আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত ‘বিশ্ব কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (World Commission on Environment and Development) হিসেবে, ১৯৮৩ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা। নরওয়ের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেম ব্রুন্টল্যান্ড এর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ১৯৮৭ সালে ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ (Our Common Future) নামক একটি প্রভাবশালী প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে টেকসই উন্নয়ন ধারণার বিস্তার ঘটায়। এই নিবন্ধে ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের গঠন, উদ্দেশ্য, কার্যক্রম, ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু এবং এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

প্রতিষ্ঠা ও প্রেক্ষাপট

১৯৮০-এর দশকে পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দ্রুত হ্রাস বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একই সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করছিল, এবং উন্নত দেশগুলো তাদের শিল্পায়নের ধারা বজায় রাখতে চেয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে পরিবেশ ও উন্নয়ন—এই দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয়কে সমন্বিত করে একটি নতুন উন্নয়ন paradigm বা দৃষ্টান্তের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই প্রেক্ষাপটেই জাতিসংঘ ১৯৮৩ সালে ব্রুন্টল্যান্ড কমিশন গঠন করে।

কমিশনের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন দেশ থেকে পরিবেশ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, এবং সামাজিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এম.এস. সোমানি, জুয়ান ভালদেজ, এবং শার্লস ফ্রে, প্রমুখ।

কমিশনের উদ্দেশ্য

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশগত উদ্বেগকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে না দেখে উন্নয়নের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা। কমিশনের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলো হলো:

পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা এবং তা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
উন্নয়ন এবং পরিবেশের মধ্যেকার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা এবং একটি সমন্বিত কৌশল তৈরি করা।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা এবং পরিবেশের গুণগত মান নিশ্চিত করা।
দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।

কার্যক্রম

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশন বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে, স্থানীয় জনগণের সাথে আলোচনা করে এবং পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। তারা বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করে। কমিশনের কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

বিভিন্ন দেশে সরেজমিনে পরিদর্শন এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে সংলাপ।
পরিবেশগত সমস্যা এবং উন্নয়নের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে একাধিক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে গবেষণা পরিচালনা।
জাতীয় সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নীতি প্রণয়নে সহায়তা করা।

‘আওয়ার কমন ফিউচার’ প্রতিবেদন

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনটি টেকসই উন্নয়ন ধারণাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তোলে। প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:

টেকসই উন্নয়নের সংজ্ঞা: কমিশন টেকসই উন্নয়নকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে: “এমন উন্নয়ন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে বর্তমানের প্রয়োজন মেটায়।” এই সংজ্ঞাটি পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ: প্রতিবেদনে বনভূমি ধ্বংস, মরুভূমি বিস্তার, জল দূষণ, বায়ু দূষণ, এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস-এর মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
উন্নয়নের সীমাবদ্ধতা: কমিশন স্বীকার করে যে উন্নয়ন অপরিহার্য, তবে তা পরিবেশের ক্ষতি করে হলে তা টেকসই হবে না। প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং পরিবেশগত সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কথা বলা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: পরিবেশগত সমস্যাগুলো মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কমিশন উন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানায়।
নীতিগত সুপারিশ: প্রতিবেদনে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন নীতিগত সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, এবং দূষণ হ্রাস করা।

টেকসই উন্নয়নের স্তম্ভ

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, টেকসই উন্নয়ন তিনটি প্রধান স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে গঠিত:

টেকসই উন্নয়নের স্তম্ভ
অর্থনৈতিক উন্নয়ন
পরিবেশগত সুরক্ষা	জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, দূষণ হ্রাস, প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার।
	সামাজিক উন্নয়ন	দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন।

এই তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করাই হলো টেকসই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য।

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের প্রভাব

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন ধারণাটির প্রসারে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর কিছু উল্লেখযোগ্য প্রভাব নিচে উল্লেখ করা হলো:

রিও সামিট: ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলন (United Nations Conference on Environment and Development) বা রিও সামিটে ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের সুপারিশগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। এই সম্মেলনে এজেন্ডা ২১ (Agenda 21) নামক একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যা টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি বৈশ্বিকblueprint বা নকশা হিসেবে কাজ করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা: ২০১৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals বা SDGs) ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছে।
জাতীয় নীতি ও পরিকল্পনা: ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদন বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে তাদের জাতীয় নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে উৎসাহিত করেছে। অনেক দেশ তাদের উন্নয়ন কৌশলগুলোতে টেকসই উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
পরিবেশগত আন্দোলন: এই কমিশন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের এবং সাধারণ মানুষকে পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করেছে।
কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (Corporate Social Responsibility): ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদনের প্রভাবে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।

সমালোচনা

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের কাজের কিছু সমালোচনাও রয়েছে। কিছু সমালোচকের মতে, কমিশনের প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এবং পরিবেশগত সুরক্ষার বিষয়টি তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পেয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন, কারণ এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা। তা সত্ত্বেও, ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের অবদান অনস্বীকার্য।

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের উত্তরাধিকার

ব্রুন্টল্যান্ড কমিশন টেকসই উন্নয়নের ধারণাকে একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনে পরিণত করেছে। কমিশনের প্রতিবেদন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার পথ দেখিয়েছে। বর্তমানে, টেকসই উন্নয়ন শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত বিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এজেন্ডা। ব্রুন্টল্যান্ড কমিশনের দেখানো পথে হেঁটে বিশ্ব সম্প্রদায় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

World Commission on Environment and Development. (1987). *Our Common Future*. Oxford University Press.
United Nations. (1992). *Agenda 21*. United Nations Conference on Environment and Development.
Sachs, J. D. (2015). *The Age of Sustainable Development*. Columbia University Press.

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ