বিকাশমূলক অর্থনীতি

ভূমিকা

বিকাশমূলক অর্থনীতি অর্থনীতির একটি শাখা যা দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি, বৈষম্য হ্রাস এবং টেকসই উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোর ওপরও গুরুত্ব দেয়। বিংশ শতাব্দীর পরবর্তীকালে এই শাখাটি বিশেষভাবে বিকশিত হতে শুরু করে, কারণ অনেক দেশ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি লাভ করে এবং নিজেদের উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করে।

বিকাশমূলক অর্থনীতির মূল ধারণা

বিকাশমূলক অর্থনীতি কয়েকটি মৌলিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে গঠিত। এগুলো হলো:

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: একটি নির্দিষ্ট সময়কালে একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর বৃদ্ধি।
মানব উন্নয়ন: মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আয় এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন সূচক দ্বারা পরিমাপ করা হয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের মানব উন্নয়নের মাত্রা নির্ণয় করে।
দারিদ্র্য হ্রাস: দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এবং তাদের দারিদ্র্যের মাত্রা কমিয়ে আনা। দারিদ্র্য রেখা একটি নির্দিষ্ট আয়ের স্তর, যার নিচে বসবাস করা মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বলে বিবেচিত হয়।
টেকসই উন্নয়ন: এমন উন্নয়ন যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
কাঠামোগত পরিবর্তন: একটি দেশের অর্থনীতির কাঠামোতে পরিবর্তন, যেমন কৃষি থেকে শিল্প এবং সেবা খাতের দিকে স্থানান্তর।

বিকাশমূলক অর্থনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক দেশ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি পায়। এই দেশগুলো দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন মডেল গ্রহণ করে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকান অর্থনৈতিক সাহায্য এবং পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব ছিল ব্যাপক। এই সময়ে হ্যারোড-ডোমার মডেল এবং রোস্টো’র পর্যায় তত্ত্ব-এর মতো ধারণাগুলো জনপ্রিয় ছিল।

১৯৭০-এর দশকে বিকাশমূলক অর্থনীতিতে একটি পরিবর্তন আসে। বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কাঠামো সমন্বয় কর্মসূচি (Structural Adjustment Programs) চালু করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাজার উদারীকরণ এবং বেসরকারিকরণ। তবে এই কর্মসূচিগুলো প্রায়শই সমালোচিত হয়েছে, কারণ এগুলো দরিদ্র মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

পরবর্তীকালে, অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদরা মানব উন্নয়নের ওপর জোর দেন এবং দারিদ্র্যকে শুধুমাত্র আয়ের অভাব হিসেবে না দেখে বহু-মাত্রিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলেন।

বিকাশমূলক অর্থনীতির প্রধান তত্ত্বসমূহ

বিকাশমূলক অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব প্রচলিত আছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো:

আধুনিকীকরণ তত্ত্ব: এই তত্ত্ব অনুযায়ী, দরিদ্র দেশগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর অনুকরণ করে উন্নয়ন অর্জন করতে পারে।
নির্ভরতা তত্ত্ব: এই তত্ত্ব মনে করে যে দরিদ্র দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল, এবং এই নির্ভরশীলতা তাদের উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
বিশ্ব-ระบบ তত্ত্ব: এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিশ্ব একটি একক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এবং এই ব্যবস্থায় কিছু দেশ কেন্দ্র হিসেবে এবং কিছু দেশ পরিধি হিসেবে কাজ করে। কেন্দ্র দেশগুলো পরিধি দেশগুলোকে শোষণ করে।
নব্য-উদারতাবাদ: এই তত্ত্ব বাজার অর্থনীতির ওপর জোর দেয় এবং সরকারের হস্তক্ষেপ কমানোর কথা বলে।

উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা

দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়নের পথে অনেক বাধা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো:

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।
দুর্নীতি: দুর্নীতি সম্পদের অপব্যবহার করে এবং উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
অবকাঠামোগত দুর্বলতা: যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি এবং স্বাস্থ্যসেবা-র মতো অবকাঠামোগুলোর অভাব উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
শিক্ষার অভাব: শিক্ষার অভাব মানব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাব তৈরি করে।
স্বাস্থ্য সমস্যা: রোগ এবং পুষ্টির অভাব মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে।
ঋণের বোঝা: অনেক দরিদ্র দেশ বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত, যা তাদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদকে সীমিত করে দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বাড়ছে, যা দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাব্য সমাধান
প্রতিবন্ধকতা	সম্ভাব্য সমাধান	রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা	সুশাসন প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা	দুর্নীতি	স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা	অবকাঠামোগত দুর্বলতা	অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) উৎসাহিত করা	শিক্ষার অভাব	শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়ন	স্বাস্থ্য সমস্যা	স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য বীমা চালু করা	ঋণের বোঝা	ঋণ মওকুফ বা পুনর্গঠন, বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি	জলবায়ু পরিবর্তন	পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি

বিকাশমূলক অর্থনীতির কৌশল

বিকাশমূলক অর্থনীতিতে উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান কৌশল হলো:

আমদানি বিকল্প শিল্পায়ন (Import Substitution Industrialization): এই কৌশলের অধীনে, দরিদ্র দেশগুলো নিজেদের শিল্প গড়ে তোলার জন্য আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করে।
রপ্তানি ভিত্তিক প্রবৃদ্ধি (Export-Oriented Growth): এই কৌশলের অধীনে, দরিদ্র দেশগুলো রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে।
মানব উন্নয়ন বিনিয়োগ: শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে মানব উন্নয়ন উন্নত করা।
ক্ষুদ্রঋণ (Microfinance): দরিদ্র মানুষদের ছোট আকারের ঋণ প্রদান করে তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে উৎসাহিত করা। মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের ধারণাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছেন।
টেকসই উন্নয়ন: পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব না ফেলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
দক্ষতা বৃদ্ধি: কারিগরি শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
প্রযুক্তি হস্তান্তর: উন্নত দেশ থেকে প্রযুক্তি নিয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে ব্যবহার করা।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা: আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি করা।

বর্তমান প্রবণতা

বর্তমানে বিকাশমূলক অর্থনীতিতে কিছু নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা (South-South Cooperation): উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি।
প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে উন্নয়নের নতুন সুযোগ সৃষ্টি।
সবুজ অর্থনীতি (Green Economy): পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন (Inclusive Development): সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা।
লক্ষ্যভিত্তিক উন্নয়ন (Goal-Oriented Development): জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর মতো নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কাজ করা।

কৌশলগত বিশ্লেষণ

বিকাশমূলক অর্থনীতিতে বিভিন্ন কৌশলগত বিশ্লেষণের গুরুত্ব রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো:

SWOT বিশ্লেষণ: কোনো দেশের শক্তি, দুর্বলতা, সুযোগ এবং হুমকি বিশ্লেষণ করা।
PESTEL বিশ্লেষণ: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রযুক্তিগত, পরিবেশগত এবং আইনগত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা।
ভ্যালু চেইন বিশ্লেষণ: কোনো পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপের বিশ্লেষণ করা।
খরচ-সুবিধা বিশ্লেষণ: কোনো প্রকল্পের খরচ এবং সুবিধা তুলনা করা।

ভলিউম বিশ্লেষণ

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগের পরিমাণ এবং তার প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য ভলিউম বিশ্লেষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এটি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর এর প্রভাব পরিমাপ করতে সাহায্য করে।

প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ

বিকাশমূলক অর্থনীতিতে প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। নতুন প্রযুক্তি, যেমন - কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence), বিগ ডেটা (Big Data), এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (Internet of Things) দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়নে নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে।

উপসংহার

বিকাশমূলক অর্থনীতি একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়। দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত এবং টেকসই কৌশল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানব উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সুশাসন এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে দরিদ্র দেশগুলো তাদের উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।

অর্থনীতি দারিদ্র্য শিক্ষা স্বাস্থ্য বৈষম্য টেকসই উন্নয়ন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি মোট দেশজ উৎপাদন উপনিবেশবাদ আমর্ত্য সেন মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ব ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কাঠামো সমন্বয় কর্মসূচি দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা সবুজ অর্থনীতি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা SWOT বিশ্লেষণ PESTEL বিশ্লেষণ ভ্যালু চেইন বিশ্লেষণ খরচ-সুবিধা বিশ্লেষণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিগ ডেটা ইন্টারনেট অফ থিংস

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ