বহুসংস্কৃতিবাদ

thumb|200px|একটি বহুসংস্কৃতিবাদী বিশ্বের প্রতীক

বহুসংস্কৃতিবাদ একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণা যা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন সংস্কৃতি, জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম এবং ঐতিহ্যকে সহাবস্থান ও পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়। এটি এমন একটি নীতি যা জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বজায় রাখতে উৎসাহিত করে, একই সাথে বৃহত্তর সমাজের সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে। বহুসংস্কৃতিবাদ আধুনিক বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বৈশ্বিকীকরণ এবং জনসংখ্যার স্থানান্তর-এর ফলে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

বহুসংস্কৃতিবাদের সংজ্ঞা ও ধারণা

বহুসংস্কৃতিবাদ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো বহু সংস্কৃতি। এটি এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি একটি সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে। এই সহাবস্থান শুধু সহনশীলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি সংস্কৃতিকে সম্মান জানানো এবং তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। বহুসংস্কৃতিবাদীরা মনে করেন যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সমাজের জন্য একটি সম্পদ এবং এটি সমাজের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

বহুসংস্কৃতিবাদের মূল ধারণাগুলো হলো:

সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ: সমাজে বিভিন্ন সংস্কৃতির অস্তিত্ব স্বীকার করা।
সমতা: প্রতিটি সংস্কৃতিকে সমান মর্যাদা দেওয়া এবং কোনো সংস্কৃতিকে অন্যের উপর চাপিয়ে না দেওয়া।
বাস্তবতা: সমাজের সকল সদস্যের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, যাতে তারা তাদের সংস্কৃতি বজায় রেখেও উন্নতি করতে পারে।
সংহতি: বিভিন্ন সংস্কৃতিকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করা।

বহুসংস্কৃতিবাদের প্রকারভেদ

বহুসংস্কৃতিবাদ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে। এর কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ নিচে উল্লেখ করা হলো:

বহুসংস্কৃতিবাদের প্রকারভেদ
প্রকার	বৈশিষ্ট্য	উদাহরণ
শোষণমূলক বহুসংস্কৃতিবাদ (Assimilationist multiculturalism)	সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতি ত্যাগ করে সংখ্যাগুরু সংস্কৃতিতে মিশে যেতে উৎসাহিত করা হয়।	মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরাতন অভিবাসন নীতি। \|	ভিন্নতাবাদী বহুসংস্কৃতিবাদ (Separationist multiculturalism)	বিভিন্ন সংস্কৃতি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং নিজেদের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ বজায় রাখে।		সংহত বহুসংস্কৃতিবাদ (Integrationist multiculturalism)	সংখ্যালঘুরা তাদের সংস্কৃতি বজায় রেখেও বৃহত্তর সমাজের অংশ হয় এবং সমান সুযোগ ভোগ করে।	কানাডার বহুসংস্কৃতিবাদ নীতি। \|	পারস্পরিক বহুসংস্কৃতিবাদ (Mutual multiculturalism)	সকল সংস্কৃতি একে অপরের কাছ থেকে শেখে এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।	আধুনিক ইউরোপের বহুসংস্কৃতিবাদ চর্চা। \|

বহুসংস্কৃতিবাদের ইতিবাচক দিক

বহুসংস্কৃতিবাদের অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক আলোচনা করা হলো:

সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি: বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণে সমাজ নতুন জ্ঞান, ধারণা এবং শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গির সাথে পরিচিত হয়।
সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন: বিভিন্ন সংস্কৃতি একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করার মাধ্যমে নতুন ধারণা এবং উদ্ভাবনের জন্ম দেয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অভিবাসী এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসা মানুষেরা নতুন ব্যবসা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে।
সহনশীলতা ও সমঝোতা: বহুসংস্কৃতিবাদ সমাজে সহনশীলতা, সম্মান এবং সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করে।
বিশ্ব নাগরিকত্ব: এটি মানুষকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সহযোগিতা করতে উৎসাহিত করে।

বহুসংস্কৃতিবাদের চ্যালেঞ্জসমূহ

বহুসংস্কৃতিবাদ সমাজে কিছু চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো:

সাংস্কৃতিক সংঘাত: বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং রীতিনীতির পার্থক্য থেকে সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে।
সামাজিক বিভাজন: ভাষার পার্থক্য, জাতিগত বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হতে পারে।
পরিচয় সংকট: সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং বৃহত্তর সমাজের সাথে একাত্মতা নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে।
বৈষম্য ও প্রান্তিকতা: কিছু সংস্কৃতি বা জাতিগোষ্ঠী বৈষম্য ও প্রান্তিকতার শিকার হতে পারে।
যোগাযোগের সমস্যা: ভাষার ভিন্নতা এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগের অভাবে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।

বহুসংস্কৃতিবাদ এবং রাজনৈতিক দর্শন

বহুসংস্কৃতিবাদ রাজনৈতিক দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ বহুসংস্কৃতিবাদকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে।

উদারতাবাদ: উদারতাবাদীরা ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং অধিকারের উপর জোর দেন এবং মনে করেন যে বহুসংস্কৃতিবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সমর্থন করে।
সমাজতন্ত্র: সমাজতন্ত্রীরা সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতার উপর জোর দেন এবং মনে করেন যে বহুসংস্কৃতিবাদ সমাজে বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করে।
জাতীয়তাবাদ: জাতীয়তাবাদীরা জাতীয় পরিচয় এবং সংস্কৃতির উপর জোর দেন এবং বহুসংস্কৃতিবাদকে জাতীয় সংহতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখতে পারেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহুসংস্কৃতিবাদ

বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময়ে বহুসংস্কৃতিবাদ নীতি গ্রহণ করেছে। নিচে কয়েকটি দেশের উদাহরণ দেওয়া হলো:

কানাডা: কানাডা বিশ্বের প্রথম দেশগুলির মধ্যে একটি, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে বহুসংস্কৃতিবাদ নীতি গ্রহণ করে। এই নীতি অনুযায়ী, সরকার সকল সংস্কৃতিকে সমান মর্যাদা দেয় এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করে।
অস্ট্রেলিয়া: অস্ট্রেলিয়াও বহুসংস্কৃতিবাদ নীতি অনুসরণ করে এবং অভিবাসীদের তাদের সংস্কৃতি বজায় রাখার সুযোগ দেয়।
যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্যে বহুসংস্কৃতিবাদ একটি জটিল বিষয়। এখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি সহাবস্থান করলেও, সামাজিক বিভাজন এবং সংঘাতের ঘটনা ঘটে।
জার্মানি: জার্মানি পূর্বে অভিবাসীদের সংস্কৃতি গ্রহণে উৎসাহিত করলেও, বর্তমানে বহুসংস্কৃতিবাদ নীতি অনুসরণ করছে।
ভারত: ভারত একটি বহুমাত্রিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের দেশ। এখানে বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা এবং জাতিগোষ্ঠীর মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে।

বহুসংস্কৃতিবাদ এবং শিক্ষা

শিক্ষা বহুসংস্কৃতিবাদকে সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা এবং সম্মানবোধ তৈরি করা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উদযাপন করা উচিত। বহুসংস্কৃতিবাদী শিক্ষা শিক্ষার্থীদের বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

বহুসংস্কৃতিবাদের ভবিষ্যৎ

বহুসংস্কৃতিবাদ একটি চলমান প্রক্রিয়া। বৈশ্বিক পরিবর্তন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন-এর সাথে সাথে বহুসংস্কৃতিবাদের ধারণাও পরিবর্তিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে বহুসংস্কৃতিবাদ আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক হতে পারে। তবে, এর জন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষের সহযোগিতা এবং সচেতনতা প্রয়োজন।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

Berry, J. W. (1980). Acculturation as adaptation. In H. Triandis & R. Brislin (Eds.), *Handbook of cross-cultural psychology* (pp. 291–326). Allyn & Bacon.
Kymlicka, W. (1995). *Multicultural citizenship: A liberal theory of minority rights*. Oxford University Press.
Parekh, B. (2002). *Rethinking multiculturalism*. Palgrave Macmillan.

বাহ্যিক লিঙ্ক

---

এই নিবন্ধটি বহুসংস্কৃতিবাদ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছে। এখানে বিভিন্ন সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, রাজনৈতিক দর্শন এবং বিভিন্ন দেশে এর চর্চা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া, শিক্ষা এবং ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে বহুসংস্কৃতিবাদের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। নিবন্ধটিতে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলির সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য একাধিক অভ্যন্তরীণ লিঙ্ক এবং তথ্যসূত্র যুক্ত করা হয়েছে।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ