ফিউচার ট্রেডিংয়ের নিয়মাবলী
ফিউচার ট্রেডিংয়ের নিয়মাবলী
ভূমিকা
ফিউচার ট্রেডিং একটি জটিল আর্থিক বাজার, যেখানে ভবিষ্যতে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একটি সম্পদ কেনা বা বেচার জন্য চুক্তি করা হয়। এই চুক্তিগুলো ফিউচার্স কন্ট্রাক্ট নামে পরিচিত। ফিউচার ট্রেডিং বিনিয়োগকারীদের জন্য উচ্চ লিভারেজের সুযোগ প্রদান করে, যা সম্ভাব্য মুনাফা এবং ঝুঁকি উভয়ই বাড়িয়ে তোলে। এই নিবন্ধে, ফিউচার ট্রেডিংয়ের নিয়মাবলী, প্রক্রিয়া, ঝুঁকি এবং কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ফিউচার ট্রেডিং কী?
ফিউচার ট্রেডিং হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে দুটি পক্ষ ভবিষ্যতে একটি নির্দিষ্ট তারিখে এবং একটি নির্দিষ্ট দামে কোনো আর্থিক উপকরণ (যেমন: স্টক, বন্ড, কমোডিটি, কারেন্সি ইত্যাদি) কেনা বা বেচার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এই চুক্তিগুলো সাধারণত এক্সচেঞ্জ-এর মাধ্যমে হয় এবং তা মানসম্মত হয়।
- স্পট মার্কেট: এখানে তাৎক্ষণিকভাবে সম্পদ কেনা বেচা হয়।
- ফিউচার মার্কেট: এখানে ভবিষ্যতের জন্য চুক্তি করা হয়।
ফিউচার ট্রেডিংয়ের মূল ধারণা
- কন্ট্রাক্ট সাইজ (Contract Size):: প্রতিটি ফিউচার্স কন্ট্রাক্টের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকে, যা সেই সম্পদের স্ট্যান্ডার্ড ইউনিট নির্দেশ করে।
- ডেলিভারি তারিখ (Delivery Date):: যে তারিখে কন্ট্রাক্টটি নিষ্পত্তি হবে।
- ফাইনান্সিয়াল সেটেলমেন্ট (Financial Settlement):: কিছু কন্ট্রাক্ট ডেলিভারির পরিবর্তে নগদ অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়।
- মার্জিন (Margin):: ফিউচার ট্রেডিংয়ের জন্য বিনিয়োগকারীকে ব্রোকারের কাছে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হয়, যা মার্জিন নামে পরিচিত।
- লিভারেজ (Leverage):: ফিউচার ট্রেডিংয়ে লিভারেজের মাধ্যমে কম মূলধন দিয়েও বড় পজিশন নেওয়া যায়।
ফিউচার ট্রেডিংয়ের নিয়মাবলী
বিভিন্ন দেশের ফিউচার মার্কেট বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই নিয়মাবলী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা এবং বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। নিচে কিছু সাধারণ নিয়মাবলী আলোচনা করা হলো:
- নিয়ন্ত্রক সংস্থা: সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (SEC) এবং কমোডিটি ফিউচার্স ট্রেডিং কমিশন (CFTC) এর মতো সংস্থা ফিউচার মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে।
- সদস্যপদ (Membership):: ফিউচার ট্রেডিং করার জন্য এক্সচেঞ্জের সদস্য হওয়া বা কোনো ব্রোকারের মাধ্যমে ট্রেড করা আবশ্যক।
- মার্জিন প্রয়োজনীয়তা: ব্রোকার এবং এক্সচেঞ্জ মার্জিন নির্ধারণ করে, যা ট্রেড করার জন্য জমা রাখতে হয়।
- পজিশন লিমিট (Position Limit):: একজন বিনিয়োগকারী একটি নির্দিষ্ট কন্ট্রাক্টের বেশি পজিশন নিতে পারে না।
- ডেলিভারি প্রক্রিয়া: ডেলিভারি তারিখের আগে কন্ট্রাক্ট নিষ্পত্তি করতে হয়, তা না হলে সম্পদ ডেলিভারি নিতে বা দিতে হতে পারে।
- রিপোর্টিং প্রয়োজনীয়তা: ট্রেডারদের তাদের ট্রেড এবং পজিশন নিয়মিতভাবে রিপোর্ট করতে হয়।
ফিউচার ট্রেডিংয়ের প্রক্রিয়া
ফিউচার ট্রেডিংয়ের প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
1. ব্রোকার নির্বাচন: একজন নির্ভরযোগ্য ব্রোকার নির্বাচন করা প্রথম ধাপ। 2. অ্যাকাউন্ট খোলা: ব্রোকারের কাছে একটি ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। 3. মার্জিন জমা দেওয়া: অ্যাকাউন্টে প্রয়োজনীয় মার্জিন জমা দিতে হবে। 4. কন্ট্রাক্ট নির্বাচন: ট্রেড করার জন্য উপযুক্ত ফিউচার্স কন্ট্রাক্ট নির্বাচন করতে হবে। 5. অর্ডার প্লেস করা: ব্রোকারের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অর্ডার প্লেস করতে হবে। 6. পজিশন পর্যবেক্ষণ: ট্রেড চলাকালীন পজিশন পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনে সংশোধন করতে হবে। 7. 'পজিশন স্কয়ার অফ (Square off): ডেলিভারি তারিখের আগে পজিশন স্কয়ার অফ করতে হবে অথবা কন্ট্রাক্ট ডেলিভারি নিতে হবে।
ফিউচার ট্রেডিংয়ের প্রকারভেদ
ফিউচার ট্রেডিং বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা সম্পদের প্রকারের উপর নির্ভর করে:
- কমোডিটি ফিউচার (Commodity Future):: সোনা, রূপা, তেল, গ্যাস, গম, চিনি ইত্যাদি পণ্যের ফিউচার ট্রেডিং।
- ফাইন্যান্সিয়াল ফিউচার (Financial Future):: স্টক ইনডেক্স, বন্ড, মুদ্রা (Currency) এবং সুদের হার (Interest Rate) এর ফিউচার ট্রেডিং।
- কারেন্সি ফিউচার (Currency Future):: বিভিন্ন দেশের মুদ্রার ফিউচার ট্রেডিং, যেমন: USD/INR।
- ক্রিপ্টোকারেন্সি ফিউচার (Cryptocurrency Future):: বিটকয়েন, ইথেরিয়াম এর মতো ক্রিপ্টোকারেন্সির ফিউচার ট্রেডিং।
ফিউচার ট্রেডিংয়ের ঝুঁকি
ফিউচার ট্রেডিংয়ে অনেক ঝুঁকি রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত:
- লিভারেজ ঝুঁকি: লিভারেজের কারণে সামান্য বাজার পরিবর্তনেও বড় ধরনের লাভ বা ক্ষতি হতে পারে।
- বাজারের ঝুঁকি: বাজারের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনে বিনিয়োগের মূল্য কমে যেতে পারে।
- লিকুইডিটি ঝুঁকি: কিছু কন্ট্রাক্টে লেনদেন কম होनेর কারণে দ্রুত পজিশন স্কয়ার অফ করা কঠিন হতে পারে।
- ক্রেডিট ঝুঁকি: ব্রোকার দেউলিয়া হলে বিনিয়োগের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
- বেসিস ঝুঁকি: স্পট মার্কেট এবং ফিউচার মার্কেটের মধ্যে দামের পার্থক্য থেকে ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে।
| ঝুঁকি | প্রতিকার | লিভারেজ ঝুঁকি | স্টপ-লস অর্ডার ব্যবহার করা, মার্জিন কম রাখা | বাজারের ঝুঁকি | ডাইভারসিফিকেশন, সঠিক বিশ্লেষণ | লিকুইডিটি ঝুঁকি | বেশি লিকুইড কন্ট্রাক্ট নির্বাচন করা | ক্রেডিট ঝুঁকি | নির্ভরযোগ্য ব্রোকার নির্বাচন করা | বেসিস ঝুঁকি | বেসিস ট্রেডিং কৌশল ব্যবহার করা |
ফিউচার ট্রেডিংয়ের কৌশল
সফল ফিউচার ট্রেডিংয়ের জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে:
- ট্রেন্ড ফলোয়িং (Trend Following):: বাজারের প্রবণতা অনুসরণ করে ট্রেড করা। মুভিং এভারেজ এবং ট্রেন্ডলাইন ব্যবহার করে প্রবণতা নির্ণয় করা যায়।
- রেঞ্জ ট্রেডিং (Range Trading):: একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে দামের ওঠানামা থেকে লাভ বের করা। সাপোর্ট এবং রেজিস্টেন্স লেভেল চিহ্নিত করে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়।
- ব্রেকআউট ট্রেডিং (Breakout Trading):: যখন দাম একটি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ভেঙে যায়, তখন ট্রেড করা।
- স্কাল্পিং (Scalping):: খুব অল্প সময়ের মধ্যে ছোট ছোট লাভ করা।
- পজিশন ট্রেডিং (Position Trading):: দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য ট্রেড করা।
- আর্বিট্রেজ (Arbitrage):: বিভিন্ন মার্কেটে দামের পার্থক্য থেকে লাভ করা।
টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ (Technical Analysis)
টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ ফিউচার ট্রেডিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ঐতিহাসিক দাম এবং ভলিউমের ডেটা ব্যবহার করে ভবিষ্যতের দামের গতিবিধি прогнозировать সাহায্য করে। কিছু জনপ্রিয় টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর হলো:
- মুভিং এভারেজ (Moving Average):: দামের গড় গতিবিধি নির্ণয় করে।
- আরএসআই (RSI - Relative Strength Index):: অতিরিক্ত কেনা বা বেচা হয়েছে কিনা, তা নির্দেশ করে।
- এমএসিডি (MACD - Moving Average Convergence Divergence):: দুটি মুভিং এভারেজের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করে।
- ফিবোনাচি রিট্রেসমেন্ট (Fibonacci Retracement):: সম্ভাব্য সাপোর্ট এবং রেজিস্টেন্স লেভেল চিহ্নিত করে।
- বলিঙ্গার ব্যান্ড (Bollinger Bands):: দামের অস্থিরতা পরিমাপ করে।
ভলিউম বিশ্লেষণ (Volume Analysis)
ভলিউম বিশ্লেষণ বাজারের গতিবিধি বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এটি ট্রেডিং ভলিউমের পরিবর্তন দেখে বাজারের শক্তি এবং দুর্বলতা নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
- অন-ব্যালেন্স ভলিউম (OBV - On Balance Volume):: দাম এবং ভলিউমের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে।
- ভলিউম ওয়েটেড এভারেজ প্রাইস (VWAP - Volume Weighted Average Price):: একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গড় দাম নির্ণয় করে।
ফিউচার ট্রেডিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা
- গভীর বাজার জ্ঞান: ফিউচার মার্কেট এবং বিভিন্ন সম্পদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকতে হবে।
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং তা নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা থাকতে হবে।
- মানসিক дисциплиন: আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।
- বিশ্লেষণ ক্ষমতা: টেকনিক্যাল এবং ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাজারের গতিবিধি прогнозировать পারদর্শী হতে হবে।
- দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ: বাজারের দ্রুত পরিবর্তনে দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।
উপসংহার
ফিউচার ট্রেডিং একটি জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া। সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা এবং কৌশল অবলম্বন করে এই বাজারে সফল হওয়া সম্ভব। বিনিয়োগকারীদের উচিত নিজেদের ঝুঁকির সহনশীলতা বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে ফিউচার ট্রেডিংয়ে অংশগ্রহণ করা।
আরও জানতে:
- মার্জিন কল
- স্টপ-লস অর্ডার
- টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর
- ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- পোর্টফোলিও ডাইভারসিফিকেশন
- এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ETF)
- অপশন ট্রেডিং
- ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট (Forex)
- কমোডিটি মার্কেট
- শেয়ার বাজার
- বন্ড মার্কেট
- মুদ্রাস্ফীতি
- অর্থনৈতিক সূচক
- বৈশ্বিক অর্থনীতি
- বিনিয়োগের মৌলিক নীতি
- ট্রেডিং সাইকোলজি
- মানি ম্যানেজমেন্ট
- পজিশন সাইজিং
- স্বয়ংক্রিয় ট্রেডিং (Automated Trading)
- অ্যালগরিদম ট্রেডিং (Algorithmic Trading)
- ফিনান্সিয়াল মডেলিং
- ডেরিভেটিভস
- হেজিং
- স্প্রেড ট্রেডিং
- ডে ট্রেডিং
- সুইং ট্রেডিং
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
