প্রাচীন বাংলার

প্রাচীন বাংলা

প্রাচীন বাংলা বলতে বোঝায় ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বে অবস্থিত বঙ্গ নামক অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি। এই অঞ্চলের ইতিহাস প্রায় তিন হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো, যা বিভিন্ন সাম্রাজ্য, রাজবংশ এবং সংস্কৃতির উত্থান-পতন দেখেছে। প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক সীমানা বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট

প্রাচীন বাংলার ভূপ্রকৃতি ছিল অত্যন্ত উর্বর এবং জলবহুল। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, ও মেঘনা নদী এবং তাদের অসংখ্য উপনদী এই ভূমিকে করেছে পলল-সমৃদ্ধ। এই নদীগুলি কেবল কৃষিকাজের জন্য সহায়ক ছিল না, বরং যোগাযোগ ও বাণিজ্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঘন বনভূমি এবং নদীর বদ্বীপ অঞ্চলটি বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল।

প্রাগৈতিহাসিক বাংলা

প্রাচীন বাংলার প্রাগৈতিহাসিক যুগ সম্পর্কে তেমন বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে archaeologists-দের খননকার্য থেকে জানা যায় যে, এই অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৬০০০ বছর আগে থেকেই মানুষের বসতি ছিল। মহেনজোদারো ও হরপ্পার মতো সিন্ধু সভ্যতার সাথে বাংলার যোগসূত্র পাওয়া যায়। চন্দ্রকেতুগড় এবং পাহাড়পুর-এর মতো স্থানে প্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্বিক নিদর্শনগুলি এই অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতার ইঙ্গিত দেয়।

প্রাচীন রাজনৈতিক ইতিহাস

প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস বিভিন্ন রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের অধীনে বিকশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

মৌর্য সাম্রাজ্য : খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অশোক-এর সময় বাংলা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সময়কালে বৌদ্ধধর্ম-এর বিস্তার ঘটে।
শুঙ্গ বংশ : মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর শুঙ্গ বংশের অধীনে বাংলা আসে।
কুশন সাম্রাজ্য: প্রথম শতাব্দীতে কুশনরা এই অঞ্চল দখল করে। কনিষ্ক-এর शासनকালে গান্ধার শিল্পকলার প্রভাব বাংলার শিল্পকলায় দেখা যায়।
গুপ্ত সাম্রাজ্য : চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলা ছিল। এই সময়কালে সামন্তবাদ-এর বিকাশ ঘটে এবং হিন্দুধর্ম-এর পুনরুজ্জীবন হয়।
পাল সাম্রাজ্য : অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পাল বংশ বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। ধর্মপাল, দেবপাল এবং মহিপাল ছিলেন এই বংশের উল্লেখযোগ্য রাজা। পাল আমলে বৌদ্ধধর্ম ও তন্ত্র-এর বিশেষ উন্নতি হয়। সোমপুর মহাবিহার (বর্তমানে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার) পাল স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
সেন সাম্রাজ্য : দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন বংশ পালদের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে। বিজয়সেন এবং বল্লালসেন ছিলেন এই বংশের প্রধান শাসক। সেন আমলে হিন্দুধর্ম-এর প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় এবং সাহিত্য ও শিল্পকলার বিকাশ ঘটে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা বরু চণ্ডীদাস সেন যুগের কবি ছিলেন।

প্রাচীন বাংলার রাজবংশ
রাজবংশ	সময়কাল	গুরুত্বপূর্ণ শাসক		মৌর্য	খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী	অশোক		শুঙ্গ	খ্রিস্টপূর্ব ২য়-১ম শতাব্দী	-		কুশন	১ম শতাব্দী	কনিষ্ক		গুপ্ত	৪র্থ-৬ষ্ঠ শতাব্দী	-		পাল	৮ম-১২শ শতাব্দী	ধর্মপাল, দেবপাল, মহিপাল		সেন	১২শ-১৩শ শতাব্দী	বিজয়সেন, বল্লালসেন

অর্থনীতি

প্রাচীন বাংলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর ছিল। ধান, গম, যব, ডাল এবং অন্যান্য শস্য এখানে উৎপাদিত হতো। নদী এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় মৎস্য শিকার এবং লবণ উৎপাদনও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। প্রাচীন বাংলা বাণিজ্য ক্ষেত্রেও সমৃদ্ধ ছিল। ভারত, চীন, রোম এবং মধ্যপ্রাচ্য-এর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। মু silk, মসলা, পাথর, এবং তামা-র মতো পণ্য এখানে উৎপাদন হতো এবং বিদেশে রপ্তানি করা হতো।

সমাজ

প্রাচীন বাংলার সমাজ বর্ণপ্রথা-ভিত্তিক ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র - এই চারটি বর্ণে বিভক্ত ছিল। তবে সমাজের বাইরে চণ্ডাল ও অন্যান্য দলিত শ্রেণির মানুষেরাও বসবাস করত। পারিবারিক কাঠামো ছিল পিতৃতান্ত্রিক। নারীদের সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তবে কিছু ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা ও শিল্পকলায় অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল।

ধর্ম

প্রাচীন বাংলায় হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম - তিনটি ধর্মই প্রচলিত ছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটে এবং পাল আমলে এটি রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সেন আমলে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন হয়। মহাযান বৌদ্ধধর্ম এবং তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম এই সময়ে বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। জৈনধর্মও বাংলার সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

সংস্কৃতি

প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, সংগীত ও নৃত্য - সকল ক্ষেত্রে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। চর্যাপদ হলো বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। পাল ও সেন আমলে স্থাপত্যকলার বিকাশ ঘটে, যার উদাহরণস্বরূপ সোমপুর মহাবিহার, ধর্মরাজ রatha, এবং কান্নাগড়-এর মন্দিরগুলি উল্লেখযোগ্য।

শিক্ষা

প্রাচীন বাংলায় তক্ষশীলা ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। বৌদ্ধ বিহারগুলি শিক্ষা ও ধর্মীয় চর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়টিও ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে দর্শন, ব্যাকরণ, তত্ত্ব, ও চিকিৎসা-র মতো বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হতো।

প্রযুক্তি

প্রাচীন বাংলার মানুষ কৃষি, শিল্পকলা, ও স্থাপত্য-এর ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করত। ধাতুবিদ্যা, কুমার শিল্প, ও বয়ন শিল্প-এ তারা দক্ষ ছিল। নৌকা নির্মাণ ও পানি ব্যবস্থাপনা-র ক্ষেত্রেও তাদের জ্ঞান ছিল উল্লেখযোগ্য।