নব্য উদারতাবাদ

নব্য উদারতাবাদ (Neoliberalism) বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতাদর্শ। এটি উদারনীতিবাদের একটি আধুনিক রূপ যা বাজারের অবাধীকরণ, বেসরকারিকরণ, deregulations (নিয়ন্ত্রণ বিলোপ), হ্রাসকৃত সরকারি ব্যয় এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের উপর জোর দেয়। এই মতাদর্শের মূল প্রবক্তা হিসেবে বিবেচিত হন ফ্রিডরিখ হায়েক এবং মিল্টন ফ্রিডম্যান এর মতো অর্থনীতিবিদগণ। নব্য উদারতাবাদ কেবল একটি অর্থনৈতিক নীতি নয়, এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন যা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ হ্রাস করে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং বাজারের ক্ষমতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়।

উৎপত্তি ও বিকাশ

নব্য উদারতাবাদের ধারণাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। যুদ্ধের পর অনেক দেশেই কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করে, যেখানে সরকার জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং সামাজিক সুরক্ষার দায়িত্ব নিত। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে তেল সংকট এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দিলে এই মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই পরিস্থিতিতে, হায়েক এবং ফ্রিডম্যানের মতো অর্থনীতিবিদগণ বাজারের অবাধীকরণের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

মার্গারেট থ্যাচার (যুক্তরাজ্য) এবং রোনাল্ড রিগান (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)-এর নেতৃত্বে ১৯৮০-এর দশকে নব্য উদারতাবাদী নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা শুরু হয়। থ্যাচার বেসরকারিকরণ এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পগুলোকে ব্যক্তিগত খাতে স্থানান্তর করেন এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ক্ষমতা হ্রাস করেন। রিগানও কর হ্রাস এবং সরকারি ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে একই ধরনের নীতি গ্রহণ করেন।

নব্য উদারতাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য

বাজারের অবাধীকরণ: নব্য উদারতাবাদের মূল ভিত্তি হলো বাজারের অবাধ স্বাধীনতা। এখানে সরকার বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে দেয়, যাতে চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে দাম নির্ধারিত হতে পারে।
বেসরকারিকরণ: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোকে ব্যক্তিগত মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায় এবং দক্ষতা বাড়ে বলে মনে করা হয়।
নিয়ন্ত্রণ বিলোপ: বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিধি-নিষেধ শিথিল করা হয়, যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজে পরিচালনা করা যায়।
সরকারি ব্যয় হ্রাস: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতে সরকারি ব্যয় কমিয়ে দেওয়া হয়।
কর হ্রাস: ব্যক্তি এবং কর্পোরেট করের হার কমানো হয়, যাতে বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উৎসাহিত হয়।
বিশ্বায়ন: বাণিজ্য বাধা হ্রাস করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়।

নব্য উদারতাবাদের প্রভাব

নব্য উদারতাবাদের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এর কিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব আলোচনা করা হলো:

নব্য উদারতাবাদের প্রভাব
ইতিবাচক প্রভাব
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি
নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের প্রসার
ব্যবহারকারীদের জন্য পণ্যের বিস্তৃত পছন্দ
বিশ্ব বাণিজ্য বৃদ্ধি
দক্ষতা বৃদ্ধি (বেসরকারিকরণের ফলে)	আর্থিক সংকট (যেমন: ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট)\|

অর্থনৈতিক প্রভাব

নব্য উদারতাবাদী নীতিগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নব্য উদারতাবাদী নীতিগুলো চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে অনেক দেশেই বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে।

তবে, নব্য উদারতাবাদের সমালোচকরা মনে করেন যে এই নীতিগুলো আয় বৈষম্য বাড়িয়েছে। কর হ্রাস এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, অন্যদিকে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়েছে।

সামাজিক প্রভাব

নব্য উদারতাবাদ সামাজিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারিকরণের ফলে এই পরিষেবাগুলো সকলের জন্য সহজলভ্য নাও হতে পারে। সমালোচকদের মতে, এর ফলে সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়ে।

নব্য উদারতাবাদী ধ্যানধারণা ব্যক্তিবাদের উপর জোর দেয়, যা সামাজিক সংহতিকে দুর্বল করে দিতে পারে। সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, নব্য উদারতাবাদ সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল অংশের প্রতি উদাসীন।

রাজনৈতিক প্রভাব

নব্য উদারতাবাদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে। এটি গণতন্ত্রের ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করেছে, কারণ নব্য উদারতাবাদী নীতিগুলো প্রায়শই জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষে কাজ করে।

নব্য উদারতাবাদ বৈশ্বিক治理র ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এনেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জাতীয় সরকারগুলোর সার্বভৌমত্ব হ্রাস পেয়েছে।

নব্য উদারতাবাদের সমালোচনা

নব্য উদারতাবাদের অনেক সমালোচক রয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের মতামত নিচে উল্লেখ করা হলো:

নোয়াম চমস্কি: ভাষাবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক চমস্কি নব্য উদারতাবাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, এটি একটি "শ্রেণী যুদ্ধ" যা সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল অংশের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে।
জোসেফ স্টিглиৎস: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্টিглиৎস নব্য উদারতাবাদী নীতিগুলোর কারণে বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন।
থমাস পিকেটি: অর্থনীতিবিদ পিকেটি তার "ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি" বইতে দেখিয়েছেন যে নব্য উদারতাবাদ কীভাবে আয় বৈষম্য বাড়িয়েছে।

বাইনারি অপশন ট্রেডিং এবং নব্য উদারতাবাদ

যদিও সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, তবে নব্য উদারতাবাদের কিছু বৈশিষ্ট্য বাইনারি অপশন ট্রেডিং এর প্রসারে সাহায্য করেছে। বাজারের অবাধীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ বিলোপের ফলে অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মগুলো দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা সহজেই বিভিন্ন আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণ করতে পারছে। তবে, এই অবাধতার কারণে অনেক নতুন বিনিয়োগকারী ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন, কারণ বাইনারি অপশন ট্রেডিং একটি জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ মাধ্যম।

এখানে কিছু প্রাসঙ্গিক বাইনারি অপশন কৌশল এবং টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ সম্পর্কিত লিঙ্ক দেওয়া হলো:

উপসংহার

নব্য উদারতাবাদ একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক মতাদর্শ। এটি বিশ্ব অর্থনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। নব্য উদারতাবাদের প্রভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই মতাদর্শের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক চলছে, তবে এটি নিশ্চিত যে নব্য উদারতাবাদ আগামীতেও বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে থাকবে।

অর্থনীতি রাজনীতি সমাজ বৈশ্বিক অর্থনীতি উদারনীতিবাদ সামাজিক ন্যায়বিচার আর্থিক বাজার বিনিয়োগ দারিদ্র্য বৈষম্য সরকার বেসরকারিকরণ নিয়ন্ত্রণ বিশ্বায়ন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ফ্রিডরিখ হায়েক মিল্টন ফ্রিডম্যান মার্গারেট থ্যাচার রোনাল্ড রিগান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বিশ্ব ব্যাংক

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ