টেলিফিল্ম
টেলিফিল্ম: একটি বিস্তারিত আলোচনা
পরিচিতি
টেলিফিল্ম হলো টেলিভিশন চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ ধারা। এটি সাধারণত টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত হয় এবং সিনেমা হলের চলচ্চিত্রের তুলনায় কম বাজেট ও ভিন্ন ধরনের গল্প বলার বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। টেলিফিল্মের যাত্রা শুরু বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এবং সময়ের সাথে সাথে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
টেলিফিল্মের ইতিহাস
টেলিফিল্মের ধারণাটি প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৫০-এর দশকে টেলিভিশন সেটের বিস্তার ঘটলে, চলচ্চিত্র নির্মাতারা টেলিভিশনের জন্য স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র তৈরি করতে শুরু করেন। শুরুতে এগুলি মূলত সিনেমা হলের চলচ্চিত্রগুলির পুনর্বিন্যাস বা সংক্ষিপ্ত সংস্করণ ছিল। তবে, ধীরে ধীরে টেলিভিশন নির্মাতারা নিজস্ব মৌলিক গল্প নিয়ে টেলিফিল্ম তৈরি করতে শুরু করেন।
ষাটের দশকে, ‘বিবিধ টেলিভিশন’ (Variety television) প্রোগ্রামের মাধ্যমে টেলিফিল্মের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সত্তরের দশকে বিভিন্ন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক যেমন এবিসি, সিবিএস, এবং এনবিসি নিয়মিতভাবে টেলিফিল্ম সম্প্রচার করতে শুরু করে।
বাংলাদেশে টেলিফিল্মের যাত্রা শুরু হয় আশির দশকে। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) প্রথম দিকে কিছু টেলিফিল্ম প্রযোজনা করে, যা দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উত্থানের সাথে সাথে টেলিফিল্মের নির্মাণ আরও বৃদ্ধি পায়। এটিএন বাংলা, একাত্তর টিভি, এনটিভি এবং অন্যান্য চ্যানেলগুলো নিয়মিতভাবে টেলিফিল্ম সম্প্রচার করে আসছে।
টেলিফিল্মের প্রকারভেদ
টেলিফিল্ম বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা গল্পের বিষয়বস্তু, নির্মাণশৈলী এবং দর্শকদের পছন্দের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
- নাট্যধর্মী টেলিফিল্ম: এই ধরনের টেলিফিল্মগুলোতে সাধারণত সামাজিক, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতা এবং আবেগ-অনুভূতিগুলো তুলে ধরা হয়।
- অপরাধ টেলিফিল্ম: এই টেলিফিল্মগুলোতে রহস্য, অপরাধ এবং গোয়েন্দা গল্পের উপাদান থাকে।
- রোমান্টিক টেলিফিল্ম: এই ধরনের টেলিফিল্মগুলোতে প্রেম, ভালোবাসা এবং সম্পর্কের বিভিন্ন দিক চিত্রিত করা হয়।
- সামাজিক টেলিফিল্ম: এই টেলিফিল্মগুলো সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন - দারিদ্র্য, বৈষম্য, এবং অবিচার নিয়ে তৈরি করা হয়।
- ঐতিহাসিক টেলিফিল্ম: এই ধরনের টেলিফিল্মগুলোতে ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিত্বদের জীবন নিয়ে গল্প বলা হয়।
- ফ্যান্টাসি ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনী টেলিফিল্ম: এই টেলিফিল্মগুলোতে অলৌকিক ঘটনা, কল্পনাবিলাস এবং বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন সম্পর্কিত গল্প থাকে।
টেলিফিল্ম নির্মাণ প্রক্রিয়া
টেলিফিল্ম নির্মাণ প্রক্রিয়া একটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। নিচে এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ আলোচনা করা হলো:
১. চিত্রনাট্য লেখা: টেলিফিল্ম নির্মাণের প্রথম ধাপ হলো একটি আকর্ষণীয় এবং মৌলিক চিত্রনাট্য লেখা। চিত্রনাট্য লেখকের কাজটি হলো গল্প তৈরি করা, চরিত্র নির্মাণ করা এবং সংলাপ লেখা।
২. প্রযোজনা পরিকল্পনা: চিত্রনাট্য লেখার পর প্রযোজনা পরিকল্পনা শুরু হয়। এই পর্যায়ে বাজেট তৈরি করা, শিল্পী নির্বাচন করা, শুটিং লোকেশন নির্ধারণ করা এবং অন্যান্য কারিগরি বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হয়।
৩. শিল্পী নির্বাচন ও প্রস্তুতি: প্রযোজনা পরিকল্পনার পর শিল্পী নির্বাচন করা হয়। নির্বাচিত শিল্পীদের চরিত্র অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হয়, যেমন - পোশাক, মেকআপ এবং সংলাপ মুখস্থ করা।
৪. শুটিং: শুটিং হলো টেলিফিল্ম নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই পর্যায়ে ক্যামেরা, লাইট এবং সাউন্ডের মাধ্যমে দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়।
৫. সম্পাদনা: শুটিং শেষ হওয়ার পর সম্পাদনার কাজ শুরু হয়। এই পর্যায়ে ফুটেজগুলো সাজানো, অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেওয়া এবং শব্দ ও সঙ্গীত যোগ করা হয়।
৬. পোস্ট-প্রোডাকশন: সম্পাদনার পর পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ করা হয়। এই পর্যায়ে কালার কারেকশন, ভিজ্যুয়াল এফেক্টস এবং অন্যান্য স্পেশাল এফেক্টস যোগ করা হয়।
৭. সম্প্রচার: সবশেষে, টেলিফিল্মটি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
| সরঞ্জাম | ব্যবহার | ক্যামেরা | লাইট | সাউন্ড রেকর্ডার | মাইক্রোফোন | এডিটিং সফটওয়্যার | কালার গ্রেডিং সফটওয়্যার |
টেলিফিল্মের কলাকুশলী
একটি টেলিফিল্ম তৈরি করতে বিভিন্ন ধরনের কলাকুশলীর প্রয়োজন হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনের ভূমিকা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- পরিচালক: টেলিফিল্মের সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্ব থাকেন পরিচালকের ওপর।
- প্রযোজক: টেলিফিল্মের বাজেট, পরিকল্পনা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক দিকগুলো দেখাশোনা করেন প্রযোজক।
- চিত্রনাট্যকার: গল্পের ধারণা তৈরি করেন এবং চিত্রনাট্য লেখেন।
- ক্যামারাম্যান: ক্যামেরার মাধ্যমে দৃশ্য ধারণ করেন।
- সম্পাদক: ফুটেজ সম্পাদনা করে টেলিফিল্মটিকে চূড়ান্ত রূপ দেন।
- শিল্পনির্দেশক: শুটিং সেটের ডিজাইন এবং সাজসজ্জার দায়িত্ব পালন করেন।
- পোশাক পরিকল্পনাকারী: শিল্পীদের পোশাক নির্বাচন এবং ডিজাইন করেন।
- রূপসজ্জাকর: শিল্পীদের মেকআপ করেন।
- অভিনেতা ও অভিনেত্রী: গল্পের চরিত্রগুলোতে প্রাণ দেন।
টেলিফিল্মের জনপ্রিয়তা
টেলিফিল্মের জনপ্রিয়তার কারণ বহুবিধ। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ হলো:
- সহজলভ্যতা: টেলিফিল্মগুলো টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হওয়ার কারণে সহজেই দর্শকদের কাছে পৌঁছে যায়।
- কম বাজেট: সিনেমা হলের চলচ্চিত্রের তুলনায় টেলিফিল্মের বাজেট কম হওয়ায় প্রযোজকরা এটি তৈরি করতে আগ্রহী হন।
- বৈচিত্র্যময় গল্প: টেলিফিল্মগুলোতে বিভিন্ন ধরনের গল্প তুলে ধরা হয়, যা দর্শকদের বিভিন্ন রুচি পূরণ করে।
- সামাজিক বার্তা: অনেক টেলিফিল্ম সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে তৈরি করা হয়, যা দর্শকদের সচেতন করে তোলে।
- স্থানীয় সংস্কৃতি: টেলিফিল্মগুলোতে প্রায়শই স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়, যা দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়।
টেলিফিল্মের ভবিষ্যৎ
বর্তমানে ওয়েব সিরিজ এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় টেলিফিল্মের ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত। তবে, টেলিফিল্মের নিজস্ব দর্শকশ্রেণী রয়েছে এবং এটি এখনও টেলিভিশন চ্যানেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নির্মাতারা যদি নতুন এবং আকর্ষণীয় গল্প নিয়ে টেলিফিল্ম তৈরি করতে পারেন, তবে এটি ভবিষ্যতে আরও জনপ্রিয় হতে পারে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে টেলিফিল্মের নতুন সংস্করণ তৈরি করার সুযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশে টেলিফিল্ম
বাংলাদেশে টেলিফিল্মের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। এখানে প্রতি বছর অসংখ্য টেলিফিল্ম নির্মিত হয় এবং তা দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা-র মতো বিশেষ উৎসবে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একাধিক নতুন টেলিফিল্ম সম্প্রচার করে।
কিছু জনপ্রিয় বাংলাদেশী টেলিফিল্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- "ঘরছাড়া" - নজরুল ইসলাম পরিচালিত
- "রূপালী গিঁট" - আতিকুর রহমান পরিচালিত
- "এক মুঠো কষ্ট" - সালাউদ্দিন লাভলু পরিচালিত
- "বৃষ্টি ভেজা দিন" - মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত
টেলিফিল্ম এবং সিনেমা: পার্থক্য
টেলিফিল্ম এবং সিনেমা উভয়ই ভিজ্যুয়াল মাধ্যম হলেও এদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। নিচে একটি টেবিলে এই পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো:
| বৈশিষ্ট্য | টেলিফিল্ম | সিনেমা | বাজেট | কম | বেশি | নির্মাণ সময় | কম | বেশি | প্রেক্ষাপট | টেলিভিশন | সিনেমা হল | দৈর্ঘ্য | সাধারণত ৩০-৯০ মিনিট | সাধারণত ৯০-১২০ মিনিট বা তার বেশি | গল্প বলার ধরণ | সরল এবং সরাসরি | জটিল এবং বিস্তারিত | দর্শক | টেলিভিশন দর্শক | সিনেমা হল দর্শক |
উপসংহার
টেলিফিল্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিজ্যুয়াল মাধ্যম, যা টেলিভিশন দর্শকদের জন্য বিনোদন এবং শিক্ষামূলক উপাদান সরবরাহ করে। সময়ের সাথে সাথে টেলিফিল্মের নির্মাণশৈলী এবং বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন এসেছে, তবে এর মূল আকর্ষণ বজায় রয়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের যুগে টেলিফিল্মকে নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ রয়েছে, যা এই ধারার ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করতে পারে।
আরও দেখুন
- চলচ্চিত্র
- টেলিভিশন
- নাটক
- ওয়েব সিরিজ
- ওটিটি প্ল্যাটফর্ম
- চিত্রনাট্য
- চলচ্চিত্র পরিচালক
- অভিনেতা
- প্রযোজক
- সম্পাদনা
- ক্যামেরাম্যান
তথ্যসূত্র
- বিবিসি-র চলচ্চিত্র বিষয়ক পাতা
- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেস (IMDb)
- দ্য গার্ডিয়ান-এর চলচ্চিত্র সমালোচনা
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
