চলতি হিসাব
চলতি হিসাব : বিস্তারিত আলোচনা
ভূমিকা
চলতি হিসাব (Current Account) একটি আর্থিক বিবরণী যা একটি নির্দিষ্ট সময়কালে (সাধারণত এক বছর) একটি দেশের সাথে অন্য দেশের পণ্য, পরিষেবা, আয় এবং মূলধনের আদান-প্রদান লিপিবদ্ধ করে। এটি ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চলতি হিসাবের মাধ্যমে একটি দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। এই হিসাবের ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত একটি দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়।
চলতি হিসাবের উপাদান
চলতি হিসাব মূলত চারটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত:
১. পণ্য বাণিজ্য (Merchandise Trade): এটি দৃশ্যমান পণ্য যেমন - যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি আমদানি ও রপ্তানির পার্থক্য নির্দেশ করে। যদি রপ্তানি আয়ের পরিমাণ আমদানির চেয়ে বেশি হয়, তবে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (Trade Surplus) দেখা যায়। অন্যথায়, বাণিজ্য ঘাটতি (Trade Deficit) হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এই হিসাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
২. পরিষেবা বাণিজ্য (Service Trade): এই অংশে পরিবহন, পর্যটন, বীমা, এবং অন্যান্য পরিষেবাগুলোর লেনদেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিষেবা খাত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতে পারে।
৩. আয় (Income): এই অংশে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয় (যেমন - লভ্যাংশ, সুদ) এবং কর্মীদের রেমিটেন্স অন্তর্ভুক্ত। বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয় চলতি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. চলতি হস্তান্তর (Current Transfers): এই অংশে কোনো প্রকার প্রতিদান ছাড়াই এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাঠানো অর্থ অন্তর্ভুক্ত, যেমন - বৈদেশিক সাহায্য, অনুদান ইত্যাদি। বৈদেশিক সাহায্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত ও ঘাটতি
চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত (Current Account Surplus) মানে হলো, একটি দেশের রপ্তানি আয় তার আমদানি ব্যয়ের চেয়ে বেশি। এর ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায় এবং টাকার মান শক্তিশালী হতে পারে।
অন্যদিকে, চলতি হিসাব ঘাটতি (Current Account Deficit) মানে হলো, একটি দেশের আমদানি ব্যয় তার রপ্তানি আয়ের চেয়ে বেশি। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেতে পারে এবং টাকার মান দুর্বল হতে পারে। মুদ্রাস্ফীতি এক্ষেত্রে একটি উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
চলতি হিসাবের গুরুত্ব
- অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য: চলতি হিসাব একটি দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়।
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ: এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর প্রভাব ফেলে।
- মুদ্রার বিনিময় হার: চলতি হিসাবের মাধ্যমে মুদ্রার বিনিময় হার প্রভাবিত হতে পারে।
- বিনিয়োগের আকর্ষণ: একটি স্থিতিশীল চলতি হিসাব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে।
- নীতি নির্ধারণ: সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সহায়তা করে।
চলতি হিসাবের উপর প্রভাব বিস্তারকারী কারণসমূহ
১. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লে সাধারণত আমদানি বাড়ে, যা চলতি হিসাবে প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক নীতি একে অপরের সাথে সম্পর্কিত।
২. মুদ্রাস্ফীতি: উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি আমদানিকে উৎসাহিত করে এবং রপ্তানিকে নিরুৎসাহিত করে, যা চলতি হিসাবে ঘাটতি তৈরি করতে পারে।
৩. বিনিময় হার: টাকার মান কমে গেলে রপ্তানি সহজ হয় এবং আমদানি কঠিন হয়ে যায়, যা চলতি হিসাবকে প্রভাবিত করে। বিনিময় হার বাজারের গতিশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৪. সরকারি নীতি: সরকারের বাণিজ্য নীতি, কর নীতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতি চলতি হিসাবের উপর প্রভাব ফেলে।
৫. বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা: বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা বা উন্নতি একটি দেশের চলতি হিসাবকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্বায়ন এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চলতি হিসাব এবং মূলধন হিসাবের মধ্যে সম্পর্ক
চলতি হিসাব এবং মূলধন হিসাব (Capital Account) ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। চলতি হিসাব যেখানে পণ্য, পরিষেবা, আয় এবং হস্তান্তরের লেনদেন লিপিবদ্ধ করে, সেখানে মূলধন হিসাব আর্থিক বিনিয়োগ, যেমন - বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment - FDI), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ এবং অন্যান্য মূলধন প্রবাহের হিসাব রাখে।
যদি চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা যায়, তবে তা মূলধন হিসাব থেকে আসা বিনিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হতে পারে। তবে, দীর্ঘমেয়াদে শুধুমাত্র মূলধন প্রবাহের উপর নির্ভর করে অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা কঠিন।
চলতি হিসাবের বিশ্লেষণ
চলতি হিসাব বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচক ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- বাণিজ্য ভারসাম্য (Trade Balance): রপ্তানি এবং আমদানির মধ্যে পার্থক্য।
- পরিষেবা ভারসাম্য (Service Balance): পরিষেবা রপ্তানি এবং আমদানির মধ্যে পার্থক্য।
- আয় ভারসাম্য (Income Balance): বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয় এবং প্রদত্ত আয়ের মধ্যে পার্থক্য।
- চলতি হস্তান্তর ভারসাম্য (Current Transfer Balance): হস্তান্তরের পরিমাণ।
এই সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে একটি দেশের অর্থনীতির দুর্বলতা এবং সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিত করা যায়।
বিভিন্ন দেশের চলতি হিসাবের উদাহরণ
- জার্মানি: জার্মানির সাধারণত একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, যা তাদের চলতি হিসাবকে উদ্বৃত্ত রাখে।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায়শই একটি চলতি হিসাবের ঘাটতি দেখা যায়, কারণ তারা প্রচুর পরিমাণে পণ্য আমদানি করে।
- চীন: চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত সাধারণত বেশি, যা তাদের চলতি হিসাবকে শক্তিশালী করে।
- ভারত: ভারতের চলতি হিসাব প্রায়শই ঘাটতির মধ্যে থাকে, তবে পরিষেবা রপ্তানি এবং রেমিটেন্সের মাধ্যমে এটি কিছুটা পূরণ হয়।
বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এর সাথে চলতি হিসাবের সম্পর্ক
যদিও সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, তবে চলতি হিসাবের তথ্য বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কোনো দেশের অর্থনীতির পূর্বাভাস জানার জন্য চলতি হিসাবের তথ্য ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়তে থাকে, তবে সেই দেশের মুদ্রার মান কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই পরিস্থিতিতে, সেই দেশের মুদ্রার উপর "কল" অপশন বিক্রি করা যেতে পারে।
টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ
বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এ, টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলতি হিসাবের তথ্য ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা (Trend) নির্ধারণ করা যেতে পারে, যা ট্রেডিং সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হতে পারে।
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- চার্ট প্যাটার্ন
- মুভিং এভারেজ
- আরএসআই (RSI)
- MACD
- ফিবোনাচি রিট্রেসমেন্ট
- বোলিঙ্গার ব্যান্ড
- ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন
- সাপোর্ট এবং রেসিস্টেন্স লেভেল
- ট্রেডিং ইন্ডিকেটর
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- মানি ম্যানেজমেন্ট
- ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ
- অর্থনৈতিক ক্যালেন্ডার
উপসংহার
চলতি হিসাব একটি দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেনের চিত্র পাওয়া যায় এবং অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সহায়তা পাওয়া যায়। বাইনারি অপশন ট্রেডারদের জন্য এই হিসাবের তথ্য মূল্যবান হতে পারে, যদিও এটি সরাসরি ট্রেডিং সিদ্ধান্তের ভিত্তি নয়। তবে, অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র বুঝতে এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা নির্ধারণ করতে এটি সহায়ক।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে আরও জানতে, প্রাসঙ্গিক নিবন্ধগুলো দেখুন।
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
