ইবোলা

ইবোলা ভাইরাস রোগ

ইবোলা ভাইরাস রোগ (ইভিডি) একটি মারাত্মক এবং প্রায়শই প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ। এটি ইবোলা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। এই ভাইরাসটি ফাইলোভাইরিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ইবোলা ভাইরাস মূলত আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে দেখা যায়। বিশেষ করে মধ্য আফ্রিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলে এই রোগের প্রকোপ বেশি।

ইতিহাস

ইবোলা ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে সুদান এবং কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র-এ ১৯৭৬ সালে। এরপর থেকে সময়ে সময়ে বিভিন্ন দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাবটি ছিল ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিম আফ্রিকাতে, যেখানে ১১,৩০০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধের জন্য ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে।

ভাইরাসের প্রকারভেদ

ইবোলা ভাইরাসের প্রধান পাঁচটি প্রকারভেদ রয়েছে:

ইবোলা ভাইরাস (ইবোলা-ইভিও)
সুদান ইবোলা ভাইরাস (সুদান-ইভিও)
Bundibugyo ইবোলা ভাইরাস (বুন্ডিবাগ্যো-ইভিও)
Tai Forest ইবোলা ভাইরাস (তাই ফরেস্ট-ইভিও)
Reston ইবোলা ভাইরাস (রেস্টন-ইভিও)

এদের মধ্যে ইবোলা-ইভিও এবং সুদান-ইভিও মানুষের মধ্যে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। রেস্টন-ইভিও সাধারণত মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে রোগ সৃষ্টি করে না, তবে এটি গবেষণাগারে সংক্রমণের কারণ হতে পারে।

সংক্রমণ প্রক্রিয়া

ইবোলা ভাইরাস সাধারণত নিম্নলিখিত উপায়ে ছড়ায়:

সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে আসা: ফল বাদুড়, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, এবং অন্যান্য বন্য প্রাণীর মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
সংক্রমিত ব্যক্তির শারীরিক তরল: রক্ত, বমি, মল, লালা, এবং অন্যান্য শারীরিক তরলের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটে।
দূষিত সরঞ্জাম: সিরিঞ্জ, সূঁচ, বা অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমেও এই রোগ ছড়াতে পারে।
মৃতদেহ: মৃতদেহ স্পর্শ করার সময় ভাইরাস ছড়াতে পারে।

ইবোলা ভাইরাস বায়ু দূষণ বা জল দূষণ দ্বারা ছড়ায় না। তবে, ভাইরাসের সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুত হতে পারে।

লক্ষণসমূহ

ইবোলা ভাইরাসের লক্ষণগুলি সাধারণত সংক্রমণের ২ থেকে ২১ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:

জ্বর
তীব্র দুর্বলতা
পেশী ব্যথা
মাথাব্যথা
গলা ব্যথা
বমি বমি ভাব এবং বমি

রোগ বাড়ার সাথে সাথে আরও গুরুতর লক্ষণ দেখা যায়, যেমন:

ডায়রিয়া (রক্তাক্ত হতে পারে)
অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ
লিভার এবং কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস
স্নায়বিক সমস্যা (যেমন, বিভ্রান্তি, খিঁচুনি)

ইবোলা ভাইরাস রোগের মারাত্মক রূপের ক্ষেত্রে, অঙ্গ বিকল হতে পারে এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

রোগ নির্ণয়

ইবোলা ভাইরাস রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে:

অ্যান্টিজেন ডিটেকশন টেস্ট: এই পরীক্ষায় রোগীর রক্ত বা অন্যান্য তরলে ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্ত করা হয়।
পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর): পিসিআর পরীক্ষা ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়।
অ্যান্টিবডি টেস্ট: এই পরীক্ষায় রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সনাক্ত করা হয়।
ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি: এই পদ্ধতিতে ভাইরাসের গঠন সরাসরি দেখা যায়।

রোগ নির্ণয়ের জন্য দ্রুত এবং সঠিক পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায় এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

চিকিৎসা

ইবোলা ভাইরাস রোগের কোনো প্রমাণিত চিকিৎসা নেই। তবে, কিছু সহায়ক চিকিৎসা প্রদান করা হয়, যা রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। এই চিকিৎসাগুলির মধ্যে রয়েছে:

ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড: ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করার জন্য।
ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স: শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখা।
অক্সিজেন থেরাপি: শ্বাসকষ্টের সমস্যা সমাধানের জন্য।
রক্ত সঞ্চালন: রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য।
অন্যান্য সংক্রমণ চিকিৎসা: ইবোলা ভাইরাসের সাথে অন্যান্য সংক্রমণ দেখা দিলে তার চিকিৎসা করা।

বর্তমানে, কিছু পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন এবং ওষুধ তৈরি করা হয়েছে, যা ইবোলা ভাইরাস রোগের চিকিৎসায় কার্যকর হতে পারে। Ervebo নামক একটি ভ্যাকসিন WHO দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে এবং এটি ইবোলা প্রাদুর্ভাবের সময় ব্যবহার করা হয়।

প্রতিরোধ

ইবোলা ভাইরাস রোগ প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে:

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ: সংক্রমিত ব্যক্তি এবং প্রাণীদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি: হাত ধোয়া, নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ, এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা।
স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা: স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) ব্যবহার করা উচিত।
ভ্যাকসিনেশন: ইবোলা ভ্যাক্সিন গ্রহণ করা।
দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা: দ্রুত রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ইবোলা ভাইরাস রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

প্রাদুর্ভাব ও নিয়ন্ত্রণ

ইবোলা ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর জন্য প্রয়োজন:

দ্রুত প্রতিক্রিয়া দল: প্রাদুর্ভাবের দ্রুত সনাক্তকরণ এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য প্রশিক্ষিত দল।
যোগাযোগ স্থাপন: স্থানীয় সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা।
কোয়ারেন্টাইন: সংক্রমিত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন করা।
কন্টাক্ট ট্রেসিং: সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং তাদের পর্যবেক্ষণ করা।
নিরাপদ কবর দেওয়া: মৃতদেহ নিরাপদে কবর দেওয়া, যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়।