আব্বাসীয়
আব্বাসীয় খিলাফত
আব্বাসীয় খিলাফত ছিল মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের হাতে ধ্বংসের আগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই খিলাফত প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে বিস্তৃত ছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল।
প্রতিষ্ঠা ও পটভূমি
আব্বাসীয়রা বনু হাশিম বংশের সদস্য ছিল, যারা ইসলামের নবী মুহাম্মদের চাচা ছিলেন। উমাইয়া খিলাফত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়লে এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকলে আব্বাসীয়রা তাদের দাবি জোরালো করতে শুরু করে। আব্বাসীয়দের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আবু মুসলিম এবং আল-সাফ্ফাহ। তারা খোরাসান প্রদেশে বিদ্রোহ শুরু করেন এবং ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে কূফা শহরে উমাইয়া খিলাফতের পতন ঘটান। আল-সাফ্ফাহ প্রথম আব্বাসীয় খলিফা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম দিকের খলিফারা ছিলেন আল-সাফ্ফাহ, আল-মনসুর, আল-মাহদি এবং হারুনুর রশীদ। এদের মধ্যে হারুনুর রশীদ ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত। তার শাসনামলে আব্বাসীয় খিলাফত উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো
আব্বাসীয় খিলাফতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো উমাইয়াদের থেকে ভিন্ন ছিল। আব্বাসীয়রা কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন এবং সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করেন। প্রতিটি প্রদেশের প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন একজন والي। কেন্দ্রীয় সরকারের নজরদারিতে প্রাদেশিক শাসনকার্য পরিচালিত হতো।
আব্বাসীয়রা দিওয়ান নামে একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেন, যা সাম্রাজ্যের রাজস্ব, হিসাব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি পরিচালনা করত। এছাড়াও, তারা কাসিদা সাহিত্যকে উৎসাহিত করেন, যা খলিফাদের স্তুতি ও গুণগান করত এবং রাজনৈতিক আনুগত্য প্রকাশ করত।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
আব্বাসীয় খিলাফতের অর্থনীতি ছিল কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পকলার উপর নির্ভরশীল। বাগদাদ শহরটি ছিল প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে বণিকরা তাদের পণ্য নিয়ে আসত। আব্বাসীয়রা জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতি করেন, যা কৃষিকাজের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক ছিল।
তারা নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করেন এবং কারুশিল্পের বিকাশ ঘটান। কাগজ শিল্প চীনের কাছ থেকে শিখে আব্বাসীয়রা এটিকে উন্নত করে এবং এর উৎপাদন শুরু করে। এর ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা আরও সহজ হয়ে যায়।
সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বৈপ্লবিক অবদান
আব্বাসীয় যুগকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা হয়। এই সময়ে ফিлосоফি, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি সাধিত হয়।
- বাইতুল হিকমা (House of Wisdom): এটি ছিল বাগদাদে অবস্থিত একটি বিখ্যাত জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতরা একত্রিত হয়ে গ্রিক, ভারতীয় ও পারস্যের প্রাচীন গ্রন্থগুলি আরবিতে অনুবাদ করেন।
- আল-খুয়ারিজমি: তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতবিদ। বীজগণিতের উপর তার কাজ পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং আধুনিক গণিতের ভিত্তি স্থাপন করে।
- ইবনে সিনা: তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ও দার্শনিক। তার লেখা "আল-কানুন ফিল-তিব" (The Canon of Medicine) মধ্যযুগে চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি আদর্শ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিবেচিত হতো।
- আল-ফারাবি: তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত দার্শনিক ও সঙ্গীতজ্ঞ। তার দার্শনিক চিন্তাগুলি পশ্চিমা বিশ্বে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
- আল-জা hired: তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। তিনি গ্রহ ও নক্ষত্রের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেন এবং নির্ভুল জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত তালিকা তৈরি করেন।
- ইবনে রুশদ: তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত দার্শনিক, যিনি অ্যারিস্টটলের দর্শনকে আরবি ভাষায় ব্যাখ্যা করেন।
আব্বাসীয় খিলাফতের সাহিত্যিক অবদানও উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ফার্সি ও আরবি ভাষায় বহু মূল্যবান সাহিত্যকর্ম রচিত হয়। হাজার এক রাত (One Thousand and One Nights) নামক বিখ্যাত গল্প সংকলনটি এই যুগের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
সামরিক শক্তি ও সাম্রাজ্যের বিস্তার
আব্বাসীয় খিলাফত একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তি ছিল। তাদের সেনাবাহিনীতে তুর্কি ও আফ্রিকান ক্রীতদাসদের প্রাধান্য ছিল। আব্বাসীয়রা সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানোর জন্য বিভিন্ন দিকে অভিযান পরিচালনা করেন।
- স্পেনে উমাইয়া শাসনের অবসান ঘটাতে আব্বাসীয়রা অভিযান প্রেরণ করেন।
- পূর্ব দিকে সিন্ধু এবং পাঞ্জাব পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে।
- উত্তর আফ্রিকায় বার্বার বিদ্রোহ দমনে তারা সফল হন।
পতন ও বিভাজন
নবম শতাব্দী থেকে আব্বাসীয় খিলাফতের দুর্বলতা শুরু হয়। কেন্দ্রীয় শাসনের উপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায় এবং বিভিন্ন প্রদেশে স্বতন্ত্র শাসন গড়ে ওঠে। বুইদ ও সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্থান আব্বাসীয় খিলাফতের জন্য আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে।
দ্বাদশ শতাব্দীতে সালজুক তুর্কিরা বাগদাদ দখল করে নেয় এবং আব্বাসীয় খিলাফতের ক্ষমতা সীমিত করে দেয়। অবশেষে, ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হুলagu খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনী বাগদাদ আক্রমণ করে এবং আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটায়।
আব্বাসীয় খিলাফতের উত্তরাধিকার
আব্বাসীয় খিলাফত মুসলিম বিশ্বে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। তাদের সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্যের যে বিকাশ ঘটেছিল, তা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে। আব্বাসীয়দের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রগুলি বহু শতাব্দী ধরে জ্ঞান বিতরণের উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
আব্বাসীয় খিলাফতের পতন হলেও এর সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার আজও টিকে আছে। এটি ইসলামী ইতিহাস এবং বিশ্ব সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
টেবিল: আব্বাসীয় খলিফাদের তালিকা (প্রথম দিকের)
| খলিফার নাম | শাসনকাল | আল-সাফ্ফাহ | ৭৫0-৭৫৪ খ্রিস্টাব্দ | আল-মনসুর | ৭৫৪-৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ | আল-মাহদি | ৭৭৫-৭৮৬ খ্রিস্টাব্দ | হারুনুর রশীদ | ৭৮৬-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ | আল-আমীন | ৮০৯-৮১৩ খ্রিস্টাব্দ | আল-মা'মুন | ৮১৩-৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ |
আরও জানতে:
- ইসলাম
- খিলাফত
- উমাইয়া খিলাফত
- হারুনুর রশীদ
- বাইতুল হিকমা
- ইসলামী স্বর্ণযুগ
- মধ্যযুগীয় ইতিহাস
- বাগদাদ
- আরবি ভাষা
- ফার্সি ভাষা
- গণিত
- জ্যোতির্বিদ্যা
- চিকিৎসাশাস্ত্র
- দর্শন
- তুর্কি সাম্রাজ্য
- মোঙ্গল সাম্রাজ্য
- আল-খুয়ারিজমি
- ইবনে সিনা
- আল-ফারাবি
- আল-জা hired
- ইবনে রুশদ
এই নিবন্ধটি আব্বাসীয় খিলাফত সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়। আরও বিস্তারিত জানার জন্য, সংশ্লিষ্ট উইকিপিডিয়া পাতা এবং অন্যান্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে।
কৌশল, টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণের জন্য সহায়ক লিঙ্ক:
1. ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন 2. মুভিং এভারেজ 3. আরএসআই (রিলেটিভ স্ট্রেংথ ইনডেক্স) 4. এমএসিডি (মুভিং এভারেজ কনভারজেন্স ডাইভারজেন্স) 5. ফিবোনাচ্চি রিট্রেসমেন্ট 6. বোলিঙ্গার ব্যান্ড 7. ভলিউম ওয়েটেড এভারেজ প্রাইস (ভিডব্লিউএপি) 8. অন ব্যালেন্স ভলিউম (ওবিভি) 9. চাইকিন মানি ফ্লো 10. এল্ডার স্ক্রোলস 11. ডনচিয়ান চ্যানেল 12. প্যারাবলিক সার 13. ইচিঙ্কু ক্লাউড 14. পিভট পয়েন্ট 15. সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স লেভেল
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
