আপেক্ষিকতা তত্ত্ব

ভূমিকা

আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আলবার্ট আইনস্টাইন এই তত্ত্বের অবতারণা করেন। এটি স্থান, কাল, মহাকর্ষ এবং বস্তুর গতির মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মূলত দুটি অংশে বিভক্ত: বিশেষ আপেক্ষিকতা (Special Relativity) এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা (General Relativity)। এই উভয় তত্ত্বই চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের (Classical Physics) ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছে।

বিশেষ আপেক্ষিকতা

১৯০৫ সালে আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি দুটি স্বীকার্যের উপর প্রতিষ্ঠিত: ১. পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো সকল জড়ত্বীয় প্রসঙ্গ কাঠামো (Inertial Frame of Reference)-তে একই থাকবে। অর্থাৎ, কোনো পর্যবেক্ষক যদি ধ্রুব গতিতে চলতে থাকে, তবে তার কাছে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো একই রকম মনে হবে। ২. আলোর বেগ (Speed of Light) শূন্য মাধ্যমে সকল পর্যবেক্ষকের জন্য একই থাকবে, তা তাদের গতির উপর নির্ভরশীল নয়।

এই স্বীকার্যগুলো থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া যায়:

**সময় প্রসারণ (Time Dilation):** কোনো গতিশীল বস্তুর জন্য সময় ধীরে চলে। এর মানে হলো, একজন পর্যবেক্ষক যদি দেখেন যে অন্য একটি বস্তু খুব দ্রুত গতিতে চলছে, তবে তার কাছে মনে হবে যে বস্তুটির সময় ধীর হয়ে গেছে। সময় প্রসারণের সূত্রটি হলো:

সময় প্রসারণের সূত্র
Δt' = γΔt	যেখানে,
Δt = স্থির পর্যবেক্ষকের সময়	γ = লরেনৎস ফ্যাক্টর (Lorentz Factor)
Δt' = গতিশীল পর্যবেক্ষকের সময়	γ = 1 / √(1 - v²/c²)
v = আপেক্ষিক বেগ	c = আলোর বেগ

**দৈর্ঘ্য সংকোচন (Length Contraction):** কোনো গতিশীল বস্তুর দৈর্ঘ্য গতির দিকে সংকুচিত হয়। এর মানে হলো, একজন পর্যবেক্ষক যদি দেখেন যে অন্য একটি বস্তু খুব দ্রুত গতিতে চলছে, তবে তার কাছে মনে হবে যে বস্তুটির দৈর্ঘ্য কমে গেছে। দৈর্ঘ্য সংকোচনের সূত্রটি হলো:

L' = L / γ এখানে, L হলো স্থির বস্তুর দৈর্ঘ্য এবং L' হলো গতিশীল বস্তুর দৈর্ঘ্য।

**ভর বৃদ্ধি (Mass Increase):** কোনো বস্তুর গতি বাড়লে তার ভর বৃদ্ধি পায়। যখন কোনো বস্তু আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে চলতে শুরু করে, তখন তার ভর অসীম হয়ে যায়।

**ভর-শক্তি সমতুল্যতা (Mass-Energy Equivalence):** আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc² অনুযায়ী, ভর এবং শক্তি পরস্পর বিনিময়যোগ্য। এই সমীকরণটি পারমাণবিক শক্তি (Nuclear Energy) এবং পারমাণবিক বোমা (Atomic Bomb) তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

সাধারণ আপেক্ষিকতা

১৯১৫ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এটি মহাকর্ষকে স্থান-কালের বক্রতা (Curvature of Spacetime) হিসেবে ব্যাখ্যা করে। সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে, মহাকর্ষ কোনো শক্তি নয়, বরং ভর এবং শক্তির কারণে স্থান-কালের জ্যামিতিতে সৃষ্ট পরিবর্তন।

সাধারণ আপেক্ষিকতার মূল ধারণাগুলো হলো:

**সমতুল্যতা নীতি (Equivalence Principle):** মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এবং ত্বরণ ক্ষেত্র একই রকম। এর মানে হলো, কোনো ব্যক্তি যদি একটি বদ্ধ ঘরে থাকে, তবে সে বুঝতে পারবে না যে সে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে আছে নাকি ত্বরণ অনুভব করছে।
**স্থান-কালের বক্রতা (Curvature of Spacetime):** ভর এবং শক্তি স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়। অন্য বস্তুগুলো এই বক্রতার কারণে মহাকর্ষ অনুভব করে।
**মহাকর্ষীয় সময় প্রসারণ (Gravitational Time Dilation):** শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে সময় ধীরে চলে। এর মানে হলো, কোনো বস্তুর কাছাকাছি যেখানে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র শক্তিশালী, সেখানে সময় ধীরে অতিবাহিত হয়।

সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রমাণ

সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে:

**আলোর বিচ্যুতি (Bending of Light):** সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নক্ষত্রের আলো বেঁকে যায়। আর্থার এডdington ১৯১৯ সালে সূর্যগ্রহণের সময় এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে আইনস্টাইনের তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করেন।
**মহাকর্ষীয় লেন্সিং (Gravitational Lensing):** কোনো বিশাল গ্যালাক্সি বা কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole)-এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কারণে দূরের কোনো বস্তুর আলো বেঁকে গেলে একাধিক প্রতিবিম্ব তৈরি হতে পারে।
**সময় প্রসারণ (Time Dilation):** GPS স্যাটেলাইটগুলোতে সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রভাব বিবেচনা করা হয়। কারণ স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর থেকে অনেক উপরে থাকে, যেখানে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র দুর্বল।
**মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (Gravitational Waves):** আইনস্টাইন ১৯১৬ সালে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যা ২০১৬ সালে প্রথম সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়।