আজুলেজো

আজুলেজো : পর্তুগিজ টাইলসের শিল্প ও ইতিহাস

আজুলেজো (Azulejo) হলো এক প্রকারের চকচকে টাইলস, যা পর্তুগাল এবং ব্রাজিলের স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই টাইলসগুলি শুধু আলংকারিক উপাদান নয়, বরং পর্তুগিজ সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং শিল্পের ধারক ও বাহক। আজুলেজো শব্দটি পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশ উভয় ভাষাতেই ব্যবহৃত হয় এবং এর অর্থ "ছোট নীল টাইলস"। যদিও বর্তমানে আজুলেজো বিভিন্ন রঙে তৈরি হয়, তবে এর উৎপত্তিতে নীল রঙের প্রাধান্য ছিল।

উৎপত্তি ও ইতিহাস

আজুলেজোর ইতিহাস ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফিরে যায়। মনে করা হয়, ১২ শতাব্দীর শেষ দিকে বা ১৩ শতাব্দীর শুরুতে ক্রুসেডাররা ইসলামিক স্থাপত্য থেকে এই টাইলসের শিল্পকলা সম্পর্কে জানতে পারে এবং এটি পরবর্তীতে পর্তুগালে নিয়ে আসে। স্পেনের সেভিল এবং গ্রানাডা-র মতো শহরগুলোতে তখন এই ধরনের টাইলসের কাজ প্রচলিত ছিল। পর্তুগালের প্রথম আজুলেজো তৈরি হয় ১৫ শতাব্দীর গোড়ার দিকে।

পর্তুগালের রাজা প্রথম জন (João I) ১৪ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংল্যান্ডের উইন্ডসর ক্যাসেল পরিদর্শনের সময় এই টাইলসের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পর্তুগালে এর প্রচলন শুরু করেন। প্রথম দিকে, আজুলেজো মূলত গির্জা এবং রাজকীয় প্রাসাদের দেয়ালে ব্যবহৃত হত।

উৎপাদন প্রক্রিয়া

আজুলেজো তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। এটি সাধারণত নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করে তৈরি করা হয়:

১. কাদামাটি সংগ্রহ ও প্রস্তুতি: প্রথমে, উচ্চমানের কাদামাটি সংগ্রহ করে সেটিকে পরিষ্কার করা হয় এবং জলের সাথে মিশিয়ে নরম করা হয়। ২. টাইলস তৈরি: এরপর কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির টাইলস তৈরি করা হয়। এই টাইলসগুলো সাধারণত হাতে তৈরি করা হয়, তবে আধুনিককালে কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়। ৩. পুড়িয়ে শুকানো: টাইলসগুলোকে প্রথমে কম তাপমাত্রায় পুড়িয়ে শুকানো হয়, যাতে সেগুলি শক্ত হয় এবং পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত হয়। ৪. নকশা আঁকা: এরপর টাইলসের উপর নকশা আঁকা হয়। নকশা আঁকার জন্য সাধারণত কোবাল্ট, কপার, আয়রন এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো বিভিন্ন ধরনের রং ব্যবহার করা হয়। ৫. গ্লেজিং: নকশা আঁকা হয়ে গেলে টাইলসের উপর একটি স্বচ্ছ গ্লেজ লাগানো হয়। এই গ্লেজ টাইলসকে চকচকে করে এবং রংগুলোকে স্থায়ী করতে সাহায্য করে। ৬. চূড়ান্ত পোড়ানো: সবশেষে, টাইলসগুলোকে উচ্চ তাপমাত্রায় (প্রায় ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পুড়িয়ে নেওয়া হয়। এই চূড়ান্ত পোড়ানোর ফলে গ্লেজ গলে গিয়ে টাইলসের সাথে মিশে যায় এবং একটি টেকসই ও আকর্ষণীয় পৃষ্ঠ তৈরি হয়।

নকশা ও শৈলী

আজুলেজো নকশার ক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগরীয় সংস্কৃতি, ইসলামিক শিল্প, এবং রেনেসাঁস-এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সময়ের সাথে সাথে আজুলেজোর নকশায় বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে।

প্রাথমিক নকশা: প্রথম দিকের আজুলেজো নকশাগুলো ছিল মূলত জ্যামিতিক আকার এবং ইসলামিক মোটিফ-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি।
ম্যানুয়েলিন শৈলী: ১৬ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পর্তুগালে ম্যানুয়েলিন (Manueline) নামক একটি নতুন শৈলী জনপ্রিয় হয়। এই শৈলীতে সামুদ্রিক উপাদান, যেমন - দড়ি, শঙ্খ এবং জলজ উদ্ভিদের নকশা ব্যবহার করা হত।
chinoiserie: সপ্তদশ শতাব্দীতে চিনোসেরি (chinoiserie) নামক একটি শৈলী জনপ্রিয়তা লাভ করে, যেখানে চীনা প্রভাব যুক্ত নকশা ব্যবহার করা হত।
রোকোকো ও নিওক্লাসিক্যাল শৈলী: অষ্টাদশ শতাব্দীতে রোকোকো এবং নিওক্লাসিক্যাল শৈলী আজুলেজো নকশায় প্রভাব ফেলে। এই সময়গুলোতে জটিল অলঙ্কার এবং পৌরাণিক দৃশ্যের চিত্রণ দেখা যায়।
আধুনিক নকশা: বিংশ শতাব্দীতে আজুলেজো নকশায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। বিমূর্ত শিল্প এবং আধুনিক স্থাপত্য-এর প্রভাবের ফলে নতুন এবং উদ্ভাবনী নকশা তৈরি হয়।

ব্যবহার

আজুলেজো প্রধানত নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়:

স্থাপত্য: আজুলেজো পর্তুগিজ স্থাপত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি বিল্ডিং-এর দেয়াল, মেঝে, এবং ছাদে ব্যবহৃত হয়।
অভ্যন্তরীণ সজ্জা: আজুলেজো বাড়ি এবং অন্যান্য কাঠামোর অভ্যন্তরীন সজ্জা হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেমন - রান্নাঘর, বাথরুম এবং হলওয়েতে।
শিল্পকলা: আজুলেজো একটি শিল্প মাধ্যম হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। শিল্পীরা আজুলেজো ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের চিত্র এবং নকশা তৈরি করেন।
স্মৃতিস্তম্ভ: পর্তুগালের বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে আজুলেজো ব্যবহার করা হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ

পর্তুগালে আজুলেজোর কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

সাও বেন্টো স্টেশনের আজুলেজো প্যানেল: পর্তুগালের লিসবন শহরের সাও বেন্টো রেলওয়ে স্টেশনের দেয়ালে প্রায় ১১০০ বর্গমিটার জুড়ে আজুলেজো প্যানেল রয়েছে। এই প্যানেলগুলোতে পর্তুগালের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে।
ন্যাশনাল আজুলেজো মিউজিয়াম: লিসবনে অবস্থিত এই জাদুঘরটিতে আজুলেজো শিল্পের ইতিহাস এবং বিবর্তন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এখানে বিভিন্ন সময়ের এবং শৈলীর আজুলেজো প্রদর্শিত হয়।
জেরোনিমোস মঠ: লিসবনে অবস্থিত জেরোনিমোস মঠের দেয়ালে ম্যানুয়েলিন শৈলীর সুন্দর আজুলেজো কাজ দেখা যায়।
Palácio Nacional de Sintra: সিনট্রা জাতীয় প্রাসাদের অভ্যন্তরে আজুলেজো দ্বারা সজ্জিত বিভিন্ন কক্ষ রয়েছে।

ব্রাজিলে আজুলেজো

পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় আজুলেজো ব্রাজিল-এ বিস্তার লাভ করে। ব্রাজিলের ওল্ডা (Ouro Preto) এবং সালভাদর (Salvador) শহরের গির্জাগুলোতে সুন্দর আজুলেজো কাজ দেখা যায়। ব্রাজিলের আজুলেজো নকশায় স্থানীয় সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির প্রভাব রয়েছে।

বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ

বর্তমানে, আজুলেজো শিল্প পর্তুগাল এবং ব্রাজিলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আধুনিক প্রযুক্তি এবং নকশার উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই শিল্প আরও বিকশিত হচ্ছে। অনেক শিল্পী এবং ডিজাইনার আজুলেজোকে নতুন রূপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন, যা এটিকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে।

আজুলেজো শুধু একটি আলংকারিক উপাদান নয়, এটি পর্তুগিজ এবং ব্রাজিলীয় সংস্কৃতির একটি মূল্যবান সম্পদ। এর ঐতিহাসিক এবং শৈল্পিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ইউনেস্কো এটিকে তাদের অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বিবেচনা করছে।

শৈলী	সময়কাল	বৈশিষ্ট্য	১৬শ শতাব্দী \| সামুদ্রিক মোটিফ, দড়ি, শঙ্খ \|	১৭শ শতাব্দী \| চীনা প্রভাব, পাখির ছবি, ফুল \|	১৮শ শতাব্দী \| জটিল অলঙ্কার, ভরাট নকশা \|	১৮শ-১৯শ শতাব্দী \| পৌরাণিক দৃশ্য, সরলতা \|	২০শ-২১শ শতাব্দী \| বিমূর্ততা, নতুন রং ও আকার \|

আরও জানতে

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ