খরা
খরা : কারণ, প্রভাব এবং মোকাবিলার উপায়
ভূমিকা
খরা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাতের অভাবের কারণে সৃষ্টি হয়। এটি জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি। খরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায় এবং এর ফলে কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এই নিবন্ধে খরার কারণ, প্রভাব, প্রকারভেদ এবং এটি মোকাবিলার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
খরা কি?
খরা হলো দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হওয়া, যা জল সংকট তৈরি করে। এটি ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে এবং এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়। খরা সাধারণত কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। জাতিসংঘ অনুসারে, কোনো অঞ্চলে যদি স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের তুলনায় ৩০% কম বৃষ্টি হয়, তবে সেটিকে খরা হিসেবে গণ্য করা হয়।
খরার কারণ
খরার প্রধান কারণগুলো হলো:
- জলবায়ু পরিবর্তন: বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর ফলে বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এর কারণে অনেক অঞ্চলে খরা দেখা যাচ্ছে।
- এল নিনো এবং লা নিনা: এই দুটি জলবায়ু ঘটনা বিশ্বব্যাপী বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তন আনে, যা খরার কারণ হতে পারে।
- অতিরিক্ত জল ব্যবহার: কৃষি, শিল্প এবং গৃহস্থালিতে অতিরিক্ত জল ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর কমে যায়, যা খরা পরিস্থিতি তৈরি করে।
- বনভূমি ধ্বংস: বনভূমি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। বনভূমি ধ্বংসের ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায় এবং খরা দেখা দেয়।
- অপরিকল্পিত নগরায়ণ: নগরায়ণের ফলে কংক্রিটের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা বৃষ্টির জলকে মাটি শুষে নিতে বাধা দেয় এবং ভূগর্ভস্থ জলের স্তর কমে যায়।
- মাটির উর্বরতা হ্রাস: মাটির উর্বরতা কমে গেলে জল ধারণ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা খরা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে।
খরার প্রকারভেদ
খরাকে সাধারণত তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়:
১. আবহাওয়াভিত্তিক খরা: এটি দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে হয়। এই ধরনের খরা সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে।
২. কৃষিভিত্তিক খরা: এটি কৃষিকাজের ওপর খরার প্রভাবের কারণে সৃষ্টি হয়। যখন বৃষ্টিপাতের অভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখন কৃষিভিত্তিক খরা দেখা দেয়।
৩. জলхозяйিক খরা: এটি জল সরবরাহে ঘাটতির কারণে হয়। যখন জলাধার, নদী এবং ভূগর্ভস্থ জলের স্তর কমে যায়, তখন জলхозяйিক খরা দেখা দেয়।
খরার প্রভাব
খরার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রভাব আলোচনা করা হলো:
- কৃষির ওপর প্রভাব: খরার কারণে শস্য উৎপাদন কমে যায়, যা খাদ্য সংকট তৈরি করে। অনেক কৃষক তাদের ফসল হারাতে বাধ্য হন, যার ফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়।
- অর্থনীতির ওপর প্রভাব: খরা অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। কৃষি উৎপাদন কমে গেলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হ্রাস পায়।
- পরিবেশের ওপর প্রভাব: খরার কারণে নদী ও হ্রদ শুকিয়ে যায়, বন্যপ্রাণী মারা যায় এবং মরুভূমি প্রসারিত হয়।
- জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব: খরার কারণে পানীয় জলের অভাব দেখা দেয়, যা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। দূষিত জল পান করার কারণে রোগ ছড়াতে পারে।
- সামাজিক প্রভাব: খরার কারণে ভূমিহীনতা বাড়ে, দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
খরা মোকাবিলা করার উপায়
খরা একটি জটিল সমস্যা, তাই এটি মোকাবিলা করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় আলোচনা করা হলো:
১. জল সংরক্ষণ
- বৃষ্টির জল সংরক্ষণ: বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। এর জন্য পুকুর, জলাধার এবং অন্যান্য সংরক্ষণাগার তৈরি করা যেতে পারে।
- জলের পুনর্ব্যবহার: ব্যবহৃত জল পরিশোধন করে তা পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন - শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য জল পরিশোধন করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়।
- জলের অপচয় রোধ: জলের অপচয় রোধ করতে সচেতনতা বাড়ানো এবং জলের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।
২. কৃষি ব্যবস্থাপনা
- খরা সহনশীল ফসল: খরা সহনশীল ফসল চাষ করা উচিত, যা কম জলে বাঁচতে পারে। যেমন - বাজরা, জোয়ার, ভুট্টা ইত্যাদি।
- আধুনিক সেচ ব্যবস্থা: সেচ ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত, যেমন - ড্রিপ ইরিগেশন (Drip irrigation) এবং স্প্রিংকলার ইরিগেশন (Sprinkler irrigation)।
- শস্য বহুমুখীকরণ: একই জমিতে বিভিন্ন ধরনের শস্য চাষ করা উচিত, যাতে কোনো একটি শস্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্যগুলো থেকে আয় করা যায়।
৩. বনভূমি সংরক্ষণ
- বৃক্ষরোপণ: বনভূমি বাড়ানোর জন্য ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত।
- বনভূমি রক্ষা: বনভূমি ধ্বংস রোধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. জল সরবরাহ ব্যবস্থাপনা
- জলাধার নির্মাণ: জলাধার নির্মাণ করে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যা খরা পরিস্থিতিতে কাজে লাগে।
- নদী খনন: নদী খনন করে নাব্যতা বৃদ্ধি করা হলে জলের প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে এবং খরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হয়।
- ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবস্থাপনা: ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং জলের স্তর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. প্রযুক্তি ও গবেষণা
- আবহাওয়া পূর্বাভাস: আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রযুক্তি উন্নত করা উচিত, যাতে খরার পূর্বাভাস দেওয়া যায় এবং আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া যায়।
- গবেষণা: খরা মোকাবিলায় নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা করা উচিত।
৬. জনসচেতনতা ও শিক্ষা
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: খরার কারণ, প্রভাব এবং মোকাবিলা করার উপায় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
- শিক্ষা: শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে জলের গুরুত্ব ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে।
খরা প্রবণ অঞ্চলের উদাহরণ
- সাহারা মরুভূমি: আফ্রিকার এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে খরার শিকার।
- ক্যালিফোর্নিয়া: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রাজ্যটি প্রায়ই খরার সম্মুখীন হয়।
- অস্ট্রেলিয়া: অস্ট্রেলিয়ার অনেক অংশ খরার ঝুঁকিতে রয়েছে।
- ভারত: ভারতের মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এবং গুজরাট রাজ্য প্রায়ই খরার কবলে পড়ে।
- বাংলাদেশ: বাংলাদেশ-এর উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল খরা প্রবণ।
টেবিল: খরার প্রভাব ও মোকাবিলার উপায়
| প্রভাব | মোকাবিলার উপায় |
|---|---|
| কৃষি উৎপাদন হ্রাস | খরা সহনশীল ফসল চাষ করা |
| খাদ্য সংকট | বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা |
| অর্থনৈতিক ক্ষতি | জলের অপচয় রোধ করা |
| পরিবেশের অবক্ষয় | বনভূমি সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ করা |
| স্বাস্থ্য সমস্যা | পানীয় জলের ব্যবস্থা করা |
| সামাজিক অস্থিরতা | বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা |
উপসংহার
খরা একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মানবজীবন ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত জল ব্যবহারের কারণে খরার প্রকোপ বাড়ছে। এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জল সংরক্ষণ, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা, বনভূমি সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খরার প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব।
আরও জানতে:
- জলবায়ু পরিবর্তন
- পরিবেশ দূষণ
- বৃষ্টির জল সংরক্ষণ
- সেচ ব্যবস্থা
- বনভূমি
- কৃষি
- অর্থনীতি
- পরিবেশ
- জনস্বাস্থ্য
- সামাজিক প্রভাব
- ভূগর্ভস্থ জল
- জলাধার
- নদী খনন
- আবহাওয়া পূর্বাভাস
- গবেষণা
- খাদ্য সংকট
- দারিদ্র্য
- ভূমিহীনতা
- জাতিসংঘ
- বৈশ্বিক উষ্ণায়ন
- এল নিনো
- লা নিনা
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
