পরিবেশ

পরিবেশ

পরিবেশ (Environment) বলতে আমাদের চারপাশের সবকিছুকে বোঝায়। এর মধ্যে রয়েছে মাটি, পানি, বাতাস, গাছপালা, প্রাণী এবং অন্যান্য জীবন্ত সত্তা। পরিবেশ মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। এটি আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

পরিবেশের উপাদান

পরিবেশ মূলত দুটি উপাদানে গঠিত:

• জীবন্ত উপাদান (Biotic components): এই উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে গাছপালা, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অণুজীব।
• অজীবন্ত উপাদান (Abiotic components): এই উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে মাটি, পানি, বাতাস, আলো, তাপমাত্রা এবং খনিজ পদার্থ।

এই দুটি উপাদান একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং একে অপরের সাথে взаимодейিত।

পরিবেশ দূষণ

পরিবেশ দূষণ (Environmental pollution) হলো পরিবেশের গুণগত মানের অবনতি। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে, যেমন - শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, এবং বর্জ্য পদার্থের যত্রতত্র নিক্ষেপ। পরিবেশ দূষণের প্রধান প্রকারগুলো হলো:

পরিবেশ দূষণের প্রকারভেদ

দূষণের প্রকার

কারণ

প্রভাব

বায়ুদূষণ

শিল্পকারখানা, যানবাহন, জীবাশ্ম জ্বালানি

শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ক্যান্সার

জলদূষণ

শিল্পকারখানা, পয়ঃনিষ্কাশন, কৃষি রাসায়নিক

পানিবাহিত রোগ, জলজ প্রাণীর ক্ষতি

মাটি দূষণ

রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বর্জ্য পদার্থ

উর্বরতা হ্রাস, খাদ্য দূষণ

শব্দ দূষণ

যানবাহন, শিল্পকারখানা, উচ্চ শব্দযুক্ত যন্ত্র

শ্রবণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপ

তেজস্ক্রিয় দূষণ

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য

ক্যান্সার, জিনগত ত্রুটি

পরিবেশ দূষণের কারণ

• জনসংখ্যা বৃদ্ধি: জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি পরিবেশের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
• শিল্পায়ন: শিল্পকারখানা থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ পরিবেশকে দূষিত করে।
• urbanisation (শহরায়ন): নগরায়নের ফলে বনভূমি ধ্বংস হয় এবং দূষণ বৃদ্ধি পায়।
• কৃষি: রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটি ও পানি দূষিত করে।
• পরিবহন: যানবাহনের ধোঁয়া বায়ুদূষণ ঘটায়।
• বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: বর্জ্য পদার্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা না করার ফলে পরিবেশ দূষিত হয়।

পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তন (Climate change) হলো দীর্ঘমেয়াদী আবহাওয়ার পরিবর্তন। এটি মূলত গ্রিনহাউস গ্যাসের (Greenhouse gas) নির্গমনের কারণে ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু প্রভাব:

• তাপমাত্রা বৃদ্ধি: পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানুষের স্বাস্থ্য এবং কৃষিকাজের জন্য ক্ষতিকর।
• সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে থাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
• প্রাকৃতিক দুর্যোগ: ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, দাবানল ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা এবং সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
• জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ সুরক্ষার উপায়

পরিবেশ সুরক্ষার জন্য আমরা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি:

• পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার: সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে।
• বৃক্ষরোপণ: বেশি করে গাছ লাগিয়ে বনভূমি সৃষ্টি করতে হবে। গাছপালা বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে।
• বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: বর্জ্য পদার্থকে সঠিকভাবে পৃথক করে পুনর্ব্যবহার (Recycle) করতে হবে।
• পানি সাশ্রয়: পানির অপচয় রোধ করতে হবে এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে।
• বিদ্যুৎ সাশ্রয়: অপ্রয়োজনে আলো ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্ধ রাখতে হবে।
• সচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

পরিবেশ সুরক্ষায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি

পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে, যেমন:

• কিয়োটো প্রোটোকল (Kyoto Protocol): এটি গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমানোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি।
• প্যারিস চুক্তি (Paris Agreement): এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি।
• রামসার কনভেনশন (Ramsar Convention): এটি জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি।
• সাইটেস (CITES): এটি বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি।

পরিবেশগত অর্থনীতি (Environmental Economics)

পরিবেশগত অর্থনীতি (Environmental Economics) অর্থনীতির একটি শাখা যা পরিবেশগত সমস্যাগুলির অর্থনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করে। এটি পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করে। পরিবেশগত অর্থনীতিবিদরা পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি প্রস্তাব করেন, যেমন - কার্বন ট্যাক্স (Carbon tax), ট্রেডেবল পারমিট (Tradable permit) এবং ভর্তুকি (Subsidy)।

পরিবেশগত আইন (Environmental Law)

পরিবেশগত আইন (Environmental Law) হলো সেই আইন যা পরিবেশ সুরক্ষার সাথে সম্পর্কিত। এই আইনগুলি পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করে।

টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development)

টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) হলো এমন উন্নয়ন যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করে ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভ হলো - অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশগত সুরক্ষা।

পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য

পরিবেশের দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বায়ুদূষণ শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। জলদূষণ পানিবাহিত রোগ সৃষ্টি করতে পারে। মাটি দূষণ খাদ্য দূষণের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

পরিবেশ সুরক্ষায় প্রযুক্তির ভূমিকা

প্রযুক্তি পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ কমানো, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব।

• স্মার্ট গ্রিড (Smart grid): এটি বিদ্যুতের অপচয় কমাতে সাহায্য করে।
• ইলেকট্রিক যানবাহন (Electric vehicle): এটি বায়ুদূষণ কমাতে সাহায্য করে।
• বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন (Waste to energy): এটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি কার্যকর উপায়।
• কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial intelligence): এটি পরিবেশগত ডেটা বিশ্লেষণ করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে পরিবেশের সমস্যা

বাংলাদেশে পরিবেশের কিছু প্রধান সমস্যা হলো:

• বায়ুদূষণ: ঢাকা সহ বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা।
• জলদূষণ: শিল্পকারখানা ও পয়ঃনিষ্কাশনের কারণে নদী ও পুকুর দূষিত হচ্ছে।
• বনভূমি ধ্বংস: নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে।
• মাটি দূষণ: রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটি দূষিত করছে।
• নদীতে পলি জমা: উজানে ভূমিধসের কারণে নদীতে পলি জমা হচ্ছে, যা বন্যার কারণ হচ্ছে।

বাংলাদেশে পরিবেশ সুরক্ষার পদক্ষেপ

বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন:

• পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫: এই আইন পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে।
• বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি: সরকার বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
• নদীবাসি পুনরুদ্ধার প্রকল্প: সরকার নদীগুলোকে পুনরুদ্ধার করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
• প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ: সরকার প্লাস্টিক ব্যবহারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।

উপসংহার

পরিবেশ আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশ দূষণ টেকসই উন্নয়ন পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডল জলবায়ু জীববৈচিত্র্য বনভূমি নদী মাটি পরিবেশগত অর্থনীতি পরিবেশগত আইন রামসার কনভেনশন কিয়োটো প্রোটোকল প্যারিস চুক্তি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্মার্ট গ্রিড ইলেকট্রিক যানবাহন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কার্বন ট্যাক্স ট্রেডেবল পারমিট

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ