NPA

NPA : ঋণ খেলাপি এবং বাংলা অর্থনীতি

ভূমিকা

NPA বা Non-Performing Assets (নন-পারফর্মিং অ্যাসেটস) বাংলা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বিষয়। এটি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ। NPA মূলত সেই ঋণগুলো যা খেলাপি হয়ে গেছে, অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই নিবন্ধে NPA-এর ধারণা, কারণ, প্রভাব, শ্রেণিবিন্যাস, এবং মোকাবিলার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

NPA কী?

NPA হলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেই ঋণ বা অগ্রিম যা ৯০ দিনের বেশি সময় ধরে খেলাপি অবস্থায় আছে। অর্থাৎ, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা পার হওয়ার পরেও যদি ঋণগ্রহীতা আসল বা সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন, তবে সেই ঋণ NPA হিসেবে গণ্য হয়। NPA শুধুমাত্র ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, এটি অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন - উন্নয়নমূলক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা এবং হাউজিং ফাইনান্স কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক বিষয়।

NPA-এর কারণসমূহ

NPA সৃষ্টির পেছনে অনেক কারণ বিদ্যমান। কিছু প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

• অর্থনৈতিক মন্দা: দেশের অর্থনীতি খারাপ হলে অনেক ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। অর্থনৈতিক মন্দা ব্যবসা ও বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
• শিল্পখাতে সমস্যা: শিল্পখাতে উৎপাদনশীলতা কম হলে বা চাহিদা কমে গেলে শিল্পোদ্যোক্তারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন।
• প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না।
• ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা: ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল ঋণ মূল্যায়ন এবং তত্ত্বাবধানের কারণে NPA বৃদ্ধি পেতে পারে। ব্যাংকিং প্র্যাকটিস এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
• রাজনৈতিক প্রভাব: অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে ঋণ খেলাপি হওয়ার ঘটনা ঘটে।
• দুর্নীতি: ঋণ বিতরণে দুর্নীতি এবং অস্বচ্ছতার কারণে NPA বৃদ্ধি পায়।
• প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব: অনেক প্রকল্প সময়মতো শেষ না হওয়ার কারণে ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না।
• সুদের হার বৃদ্ধি: সুদের হার বেড়ে গেলে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের বোঝা বেড়ে যায়। সুদের হার বাজারের চাহিদা ও যোগানের উপর নির্ভরশীল।

NPA-এর শ্রেণিবিন্যাস

NPA-কে সাধারণত তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:

১. সাব-স্ট্যান্ডার্ড অ্যাসেট (Sub-Standard Asset): এই ধরনের ঋণের মেয়াদ ১২ মাস বা তার বেশি সময় ধরে খেলাপি থাকে। এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংক সাধারণত কিছু প্রভিশনিং করে থাকে।

২. ডাউটফুল অ্যাসেট (Doubtful Asset): এই ধরনের ঋণের মেয়াদ ২৪ মাস বা তার বেশি সময় ধরে খেলাপি থাকে। এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংক আরও বেশি প্রভিশনিং করে থাকে, কারণ এই ঋণ পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কম থাকে।

৩. লস অ্যাসেট (Loss Asset): এই ধরনের ঋণ সম্পূর্ণরূপে খেলাপি হয়ে যায় এবং পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা থাকে না। ব্যাংক এই ঋণের বিপরীতে সম্পূর্ণ প্রভিশনিং করে।

NPA-এর প্রভাব

NPA ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রভাব উল্লেখ করা হলো:

• মুনাফা হ্রাস: NPA-এর কারণে ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়, কারণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং করতে হয়। ব্যাংকের লাভজনকতা বজায় রাখার জন্য NPA নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
• মূলধন ঘাটতি: NPA-এর কারণে ব্যাংকের মূলধন কমে যায়, যা তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতাকে সীমিত করে দেয়।
• তারল্য সংকট: NPA-এর কারণে ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়তে পারে, কারণ খেলাপি ঋণের অর্থ আটকে থাকে।
• বিনিয়োগ হ্রাস: NPA-এর কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করেন।
• অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস: NPA অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে, কারণ এটি ঋণ প্রবাহকে কমিয়ে দেয়।

NPA মোকাবিলার উপায়

NPA মোকাবেলা করার জন্য ব্যাংক এবং সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় আলোচনা করা হলো:

• কঠোর ঋণ মূল্যায়ন: ঋণ দেওয়ার আগে ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থা এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক।
• নিয়মিত তত্ত্বাবধান: ঋণ দেওয়ার পরে নিয়মিতভাবে ঋণের তত্ত্বাবধান করতে হবে এবং খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
• ঋণ পুনরুদ্ধার: খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাংকগুলোকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন আইন ও বিধিবিধানের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
• কর্পোরেট ঋণ পুনর্গঠন: সমস্যাগ্রস্ত কোম্পানিগুলোর ঋণ পুনর্গঠন করে তাদের ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। ঋণ পুনর্গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
• সম্পদ পুনরুদ্ধার কোম্পানি (Asset Reconstruction Company): খেলাপি ঋণ কেনার জন্য সম্পদ পুনরুদ্ধার কোম্পানি গঠন করা যেতে পারে। এই কোম্পানিগুলো খেলাপি ঋণ কিনে সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে।
• দেউলিয়া আইন (Insolvency and Bankruptcy Code): দেউলিয়া আইন ব্যবহার করে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। দেউলিয়া আইন খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
• প্রযুক্তি ব্যবহার: NPA চিহ্নিতকরণ এবং পুনরুদ্ধারের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। ফিনটেক এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
• সরকারি নীতি: সরকার NPA মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করতে পারে, যেমন - ঋণ গ্যারান্টি স্কিম এবং ভর্তুকি প্রদান।

NPA এবং বাংলা অর্থনীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে NPA একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে NPA-এর পরিমাণ বেশি। NPA-এর কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি বড় হুমকি। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক NPA কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে - খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য বিশেষ আদালত গঠন, ঋণ পুনর্গঠন স্কিম এবং ব্যাংকগুলোর জন্য কঠোর নিয়মকানুন প্রণয়ন।

NPA কমাতে কিছু কৌশল

• আর্লি ডিটেকশন (Early Detection): দ্রুত NPA চিহ্নিত করতে পারলে সময় মতো ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
• প্রিভেন্টিভ মেজার (Preventive Measure): ঋণ দেওয়ার আগে ভালোভাবে যাচাই করা এবং নিয়মিত ফলোআপ করা।
• স্ট্রাকচার্ড সেটেলমেন্ট (Structured Settlement): ঋণগ্রহীতার সাথে আলোচনা করে কিস্তির পরিমাণ এবং সময়সীমা পুনর্নির্ধারণ করা।
• লিগ্যাল অ্যাকশন (Legal Action): খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়া।
• টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ: টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ ব্যবহার করে বাজারের গতিবিধি বোঝা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।
• ভলিউম বিশ্লেষণ: ভলিউম বিশ্লেষণ ব্যবহার করে ঋণের চাহিদা এবং যোগান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা।
• ফিউচার ট্রেডিং: ফিউচার ট্রেডিং এর মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো যায়।
• অপশন ট্রেডিং: অপশন ট্রেডিং ব্যবহার করে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা যায়।
• পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট: পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট এর মাধ্যমে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমানো যায়।
• রিস্ক ম্যানেজমেন্ট: রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
• ক্রেডিট স্কোরিং: ক্রেডিট স্কোরিং এর মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা মূল্যায়ন করা যায়।
• ডেরিভেটিভস: ডেরিভেটিভস ব্যবহার করে আর্থিক ঝুঁকি কমানো যায়।
• ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট: ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট সম্পর্কে জ্ঞান NPA মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারে।
• কমার্শিয়াল পেপার: কমার্শিয়াল পেপার বাজারের গতিবিধি বোঝা জরুরি।
• মানি মার্কেট: মানি মার্কেট সম্পর্কে ধারণা রাখা প্রয়োজন।
• বন্ড মার্কেট: বন্ড মার্কেট NPA ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
• স্টক মার্কেট: স্টক মার্কেটের গতিবিধি NPA-এর উপর প্রভাব ফেলে।
• মিউচুয়াল ফান্ড: মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
• ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং: ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং NPA কমাতে সাহায্য করে।

উপসংহার

NPA বাংলা অর্থনীতির জন্য একটি জটিল সমস্যা। NPA নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে NPA মোকাবিলার জন্য আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, যাতে NPA-এর পরিমাণ কমিয়ে আনা যায় এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা যায়।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ