খুলনা

খুলনা শহর : ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি এবং আধুনিক বিকাশ

ভূমিকা

খুলনা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এটি খুলনা বিভাগ-এর প্রশাসনিক কেন্দ্র। খুলনা একসময় বঙ্গাল-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল এবং সময়ের সাথে সাথে এটি বাণিজ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়েছে। এই নিবন্ধে খুলনার ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং আধুনিক বিকাশের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো।

ইতিহাস

খুলনার ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়েছে। মনে করা হয়, খুলনার নামানুসারে খুলিশপুর নামক একটি প্রাচীন জনপদ ছিল। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে এখানে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-এর शासन ছিল। মধ্যযুগে খুলনা সুবেদার শায়েস্তা খান-এর অধীনে ঢাকার একটি অংশে পরিণত হয়।

প্রাচীন যুগ: খুলনার প্রাচীন ইতিহাস হরিয়ান এবং ভ্রমরদত্ত-এর মতো রাজ্যগুলির সাথে জড়িত।
মধ্যযুগ: তুর্কি ও মুঘল শাসনের সময় খুলনা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসন: পলাশী যুদ্ধ-এর পর খুলনা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-র অধীনে আসে। এই সময়কালে খুলনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। কলকাতার সাথে খুলনার বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
পাকিস্তান যুগ: ভারত বিভাজন-এর পর খুলনা পূর্ব পাকিস্তান-এর অংশ হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ: বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ-এ খুলনা একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। খুলনা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচার করা হয়।

ভূগোল ও জলবায়ু

খুলনা ভৈরব নদী ও রূপসা নদী-র তীরে অবস্থিত। এর উত্তরে নড়াইল জেলা, পূর্বে যশোর জেলা, দক্ষিণে সাতক্ষীরা জেলা এবং পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা অবস্থিত। খুলনার আয়তন ৬,৫৬৯.৩২ বর্গ কিলোমিটার।

খুলনার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। এখানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা প্রায় ৩০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শীতকালে তাপমাত্রা প্রায় ১০-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।

অর্থনীতি

খুলনার অর্থনীতি মূলত কৃষি, শিল্প এবং বাণিজ্য-এর উপর নির্ভরশীল।

কৃষি: খুলনার প্রধান কৃষিজাত পণ্যগুলো হলো ধান, পাট, গম, তৈলবীজ, এবং নারকেল। এখানকার সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্য সম্পদ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
শিল্প: খুলনায় বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল, যুগান্তর শিল্পগোষ্ঠী, স্টার সিনথেটিক্স, এবং রূপসা চিনি কল উল্লেখযোগ্য। খালিশপুর শিল্প এলাকা খুলনার একটি প্রধান শিল্প কেন্দ্র।
বাণিজ্য: খুলনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন ধরনের পাইকারি বাজার ও খুচরা বাজার রয়েছে। বন্দরের মাধ্যমে খুলনা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্ত।
পেট্রোবাংলা এবং ওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড-এর মতো সংস্থাগুলি খুলনার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সংস্কৃতি

খুলনার সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে বিভিন্ন ধরনের উৎসব, অনুষ্ঠান এবং লোকসংগীত প্রচলিত আছে।

লোকসংগীত: খুলনার লোকসংগীতের মধ্যে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া এবং রাগিণী উল্লেখযোগ্য।
নাটক ও চলচ্চিত্র: খুলনায় বিভিন্ন নাট্যদল এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা রয়েছে। এখানকার খুলনা নাট্য সমিতি নাট্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
সাহিত্য: খুলনার সাহিত্যিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। এখানে অনেক বিখ্যাত কবি ও লেখক রয়েছেন।
স্থাপত্য: খুলনায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে, যা এখানকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। খান জাহান আলী-এর মাজার খুলনার একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন।
খাদ্য: খুলনার মাছ ও ভাত এখানকার মানুষের প্রধান খাদ্য। এছাড়াও, পিঠা, পুলি, এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি এখানকার জনপ্রিয় খাবার।

দর্শনীয় স্থান

খুলনায় অনেক সুন্দর ও আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে।

সুন্দরবন: সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এটি খুলনা থেকে কাছেই অবস্থিত এবং ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে স্বীকৃত।
খান জাহান আলী মাজার: খান জাহান আলী ছিলেন মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত সুফি সাধক। তার মাজার খুলনার খালিশপুর এলাকায় অবস্থিত।
ষাট গম্বুজ মসজিদ: বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ খুলনার কাছে অবস্থিত। এটি মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন।
কয়রা সমুদ্র সৈকত: খুলনার কয়রা উপজেলায় সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে এই সমুদ্র সৈকত অবস্থিত।
গাজী এবং চাচা ভিটা: খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত এই ঐতিহাসিক স্থানটি [[বাঙালি]_সংস্কৃতির] গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

খুলনার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত।

সড়কপথ: খুলনা দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সড়কপথের মাধ্যমে যুক্ত। এখানে ঢাকা, কলকাতা, যশোর এবং বরিশাল-এর সাথে নিয়মিত বাস চলাচল করে।
রেলপথ: খুলনার সাথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রেলপথের যোগাযোগ রয়েছে। খুলনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করে।
নৌপথ: খুলনা নৌপথের মাধ্যমেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যুক্ত। রূপসা বন্দর ও মংলা বন্দর খুলনা অঞ্চলের প্রধান নৌ বন্দর।
বিমানপথ: খুলনায় একটি বিমানবন্দর রয়েছে, যা খুলনা বিমানবন্দর নামে পরিচিত।

শিক্ষা ব্যবস্থা

খুলনার শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত। এখানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়: খুলনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
কলেজ: এখানে অনেক সরকারি ও বেসরকারি কলেজ রয়েছে। খুলনা সরকারি কলেজ, বি এল কলেজ উল্লেখযোগ্য।
স্কুল: খুলনায় বিভিন্ন ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। খুলনা জিলা স্কুল, খুলনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
কারিগরি শিক্ষা: খুলনায় খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সহ বেশ কয়েকটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

প্রশাসন

খুলনা শহর খুলনা সিটি কর্পোরেশন দ্বারা পরিচালিত হয়। খুলনা জেলা বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক জেলা। জেলার ডিসি (জেলা প্রশাসক) এবং এসপি (পুলিশ সুপার) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন।

জনসংখ্যা

২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী খুলনার জনসংখ্যা ১০,৯২,৭৪১ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১,৬৬৯ জন।

সমস্যা ও সম্ভাবনা

খুলনার কিছু সমস্যা রয়েছে, যেমন -

যানজট: খুলনার প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে যানজট অন্যতম।
জলাবদ্ধতা: বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার কারণে শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়।
দূষণ: নদী দূষণ এবং বায়ু দূষণ খুলনার পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ।

তবে, খুলনার অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে।

পর্যটন: সুন্দরবন এবং অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পকে আরও উন্নত করা সম্ভব।
শিল্পায়ন: নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে খুলনার অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করা যায়।
শিক্ষা: খুলনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

খুলনা শহরকে একটি আধুনিক ও বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: নতুন ফ্লাইওভার নির্মাণ এবং সড়ক প্রশস্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিরসন: নদী খনন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ: দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড-এর মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
স্মার্ট সিটি: খুলনাকে একটি স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

আরও দেখুন

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ