Business process reengineering
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং: একটি বিস্তারিত আলোচনা
ভূমিকা
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং (Business Process Reengineering - BPR) হল একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মপদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে নতুন করে ডিজাইন করার প্রক্রিয়া। গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন প্রযুক্তি এবং কর্মপদ্ধতির সমন্বয়ে ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকরী, দ্রুত এবং সাশ্রয়ী করে তোলাই এর মূল লক্ষ্য। বিপিআর কেবল বিদ্যমান প্রক্রিয়ার সামান্য উন্নতি নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে তৈরি করে। এটি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং এর ধারণা
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং-এর ধারণাটি ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাইকেল Hammer এবং James Champy তাঁদের ১৯৮৯ সালের বিখ্যাত বই "Reengineering the Corporation"-এর মাধ্যমে এই ধারণাটিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেন। তাঁরা বলেন, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলোকে নতুন করে ডিজাইন না করলে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। বিপিআর মূলত প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যক্রমগুলোর (Core Processes) উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যেমন - যোগাযোগ, উৎপাদন, বিপণন, এবং গ্রাহক পরিষেবা।
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং এর মূলনীতি
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং কিছু সুনির্দিষ্ট মূলনীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত। এই মূলনীতিগুলো প্রক্রিয়াটিকে সফলভাবে বাস্তবায়নে সহায়তা করে:
১. প্রক্রিয়া-ভিত্তিক সংগঠন: প্রচলিত বিভাগীয় কাঠামোর পরিবর্তে প্রক্রিয়া-ভিত্তিক কাঠামো তৈরি করা, যেখানে প্রতিটি প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে। ২. গ্রাহককেন্দ্রিকতা: সমস্ত প্রক্রিয়া গ্রাহকের চাহিদা এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিজাইন করা উচিত। গ্রাহক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা (CRM) এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ৩. প্রযুক্তির ব্যবহার: নতুন প্রযুক্তি, যেমন - কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং (ML), এবং রোবোটিক প্রসেস অটোমেশন (RPA) ব্যবহার করে প্রক্রিয়াগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করা এবং উন্নত করা। ৪. সরলীকরণ: প্রক্রিয়াগুলোকে সরল এবং ত্রুটিমুক্ত করা, যাতে অপ্রয়োজনীয় ধাপগুলো বাদ দেওয়া যায়। ৫. ক্রমাগত উন্নতি: প্রক্রিয়াগুলোকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ এবং উন্নত করা, যাতে সময়ের সাথে সাথে সেগুলি আরও কার্যকরী হয়। লিন ম্যানুফ্যাকচারিং এবং সিক্স সিগমা এক্ষেত্রে সহায়ক। ৬. ক্ষমতা বৃদ্ধি: কর্মীদের নতুন দক্ষতা অর্জন এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানো, যাতে তারা প্রক্রিয়ার পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে।
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং এর পর্যায়
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং একটি সুসংগঠিত পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন করা উচিত। এর প্রধান পর্যায়গুলো হলো:
১. প্রস্তুতি: এই পর্যায়ে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করা হয় এবং একটি শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা দল গঠন করা হয়। ২. বিশ্লেষণ: বর্তমান প্রক্রিয়াগুলো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, দুর্বলতা এবং সমস্যাগুলো খুঁজে বের করা হয়। ভ্যালু স্ট্রিম ম্যাপিং (Value Stream Mapping) এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ টুল। ৩. ডিজাইন: নতুন প্রক্রিয়াগুলো ডিজাইন করা হয়, যেখানে গ্রাহকের চাহিদা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরলীকরণের উপর জোর দেওয়া হয়। ৪. বাস্তবায়ন: নতুন প্রক্রিয়াগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়। ৫. মূল্যায়ন: বাস্তবায়িত প্রক্রিয়াগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হয় এবং প্রয়োজনে সংশোধন করা হয়। KPIs (Key Performance Indicators) ব্যবহার করে কার্যকারিতা পরিমাপ করা হয়।
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং এর সরঞ্জাম এবং কৌশল
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম এবং কৌশল ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য কৌশল হলো:
- ফ্লোচার্টিং (Flowcharting): প্রক্রিয়ার ধাপগুলো চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা।
- ভ্যালু স্ট্রিম ম্যাপিং (Value Stream Mapping): একটি প্রক্রিয়ার সমস্ত ধাপের বিশ্লেষণ এবং অপচয় চিহ্নিত করা।
- বেনচমার্কিং (Benchmarking): অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সেরা অনুশীলনগুলো অনুসরণ করা।
- ব্রেইনস্টর্মিং (Brainstorming): নতুন ধারণা এবং সমাধান খুঁজে বের করা।
- সিমুলেশন (Simulation): নতুন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের আগে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা।
- ডাটা মাইনিং (Data Mining): ডেটা থেকে মূল্যবান তথ্য বের করে প্রক্রিয়া উন্নত করা।
- কজ-এন্ড-ইফেক্ট ডায়াগ্রাম (Cause-and-Effect Diagram): সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা।
- ফিশবোন ডায়াগ্রাম (Fishbone Diagram): সমস্যার কারণগুলো বিশ্লেষণ করা।
- প্যারিতো চার্ট (Pareto Chart): সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা।
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং এর সুবিধা
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক সুবিধা নিয়ে আসে। এর মধ্যে কিছু প্রধান সুবিধা হলো:
- কার্যকারিতা বৃদ্ধি: প্রক্রিয়াগুলো সরল এবং স্বয়ংক্রিয় করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
- খরচ হ্রাস: অপচয় কমিয়ে এবং সম্পদ ব্যবহার অপটিমাইজ করার মাধ্যমে খরচ কমানো যায়।
- গুণমান বৃদ্ধি: গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী প্রক্রিয়া ডিজাইন করার মাধ্যমে পণ্যের এবং সেবার গুণমান বৃদ্ধি পায়।
- গ্রাহক সন্তুষ্টি: দ্রুত এবং উন্নত পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।
- প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা: নতুন প্রযুক্তি এবং কর্মপদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্তিশালী হয়।
- কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি: ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ কর্মীদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে।
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং এর অসুবিধা এবং ঝুঁকি
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া হলেও এর কিছু অসুবিধা এবং ঝুঁকি রয়েছে। এগুলো হলো:
- প্রতিরোধ: কর্মীরা পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা মনে করে যে তাদের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়বে।
- ব্যয়বহুল: বিপিআর বাস্তবায়ন করতে অনেক সময় এবং অর্থ প্রয়োজন হয়।
- জটিলতা: প্রক্রিয়াগুলো জটিল হতে পারে এবং বাস্তবায়ন করা কঠিন হতে পারে।
- ব্যর্থতার ঝুঁকি: ভুল পরিকল্পনা বা বাস্তবায়নের কারণে বিপিআর ব্যর্থ হতে পারে।
- যোগাযোগের অভাব: কর্মীদের মধ্যে পর্যাপ্ত যোগাযোগ না থাকলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং বাস্তবায়নের সময় কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত:
- স্পষ্ট উদ্দেশ্য: বিপিআর-এর উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
- ব্যবস্থাপনার সমর্থন: শীর্ষ ব্যবস্থাপনার সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রয়োজন।
- কর্মীদের সম্পৃক্ততা: কর্মীদের পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
- প্রশিক্ষণ: কর্মীদের নতুন প্রযুক্তি এবং কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- যোগাযোগ: কর্মীদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।
- পর্যালোচনা: প্রক্রিয়াগুলোর কার্যকারিতা নিয়মিত পর্যালোচনা করতে হবে।
- ধৈর্য: বিপিআর একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, তাই ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে।
পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা (Change Management) এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিছু সফল বিপিআর উদাহরণ
- ওয়াল-মার্ট (Walmart): ওয়াল-মার্ট তাদের সরবরাহ চেইন (Supply Chain) এবং ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনার (Inventory Management) জন্য বিপিআর ব্যবহার করে বিশ্বে সফল হয়েছে।
- আইবিএম (IBM): আইবিএম তাদের ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলো নতুন করে ডিজাইন করে গ্রাহককেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি করেছে এবং খরচ কমিয়েছে।
- ডুপন্ট (DuPont): ডুপন্ট তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য বিপিআর ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে।
- ফেডএক্স (FedEx): ফেডএক্স তাদের প্যাকেজ ডেলিভারি সিস্টেমকে উন্নত করতে বিপিআর ব্যবহার করেছে।
ভবিষ্যতের প্রবণতা
ভবিষ্যতে, বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং আরও প্রযুক্তি-নির্ভর হবে বলে আশা করা যায়। ব্লকচেইন, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), এবং বিগ ডেটা (Big Data) এর মতো প্রযুক্তিগুলো বিপিআর প্রক্রিয়ায় আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া, অটোমেশন এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলোকে আরও বুদ্ধিমান এবং স্বয়ংক্রিয় করে তুলবে।
উপসংহার
বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং একটি শক্তিশালী কৌশল, যা প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা, গ্রাহক সন্তুষ্টি এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। তবে, এটি বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এবং কর্মীদের সহযোগিতা প্রয়োজন। যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে, বিপিআর একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করতে পারে।
আরো জানতে:
- কার্যক্রম বিশ্লেষণ
- গুণমান নিয়ন্ত্রণ
- যোগাযোগ ব্যবস্থা
- মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা
- প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন
- অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ
- মার্কেটিং কৌশল
- সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- প্রকল্প ব্যবস্থাপনা
- ডাটা বিশ্লেষণ
- সিদ্ধান্ত গ্রহণ
- উদ্ভাবন ব্যবস্থাপনা
- নেতৃত্বের বিকাশ
- সাংগঠনিক সংস্কৃতি
- বৈশ্বিক ব্যবসায়
- ই-কমার্স
- ডিজিটাল মার্কেটিং
- গ্রাহক অভিজ্ঞতা
- ব্র্যান্ডিং
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
