মনোযোগ deficit hyperactivity disorder

মনোযোগ ঘাটতি অতি সক্রিয়তা ব্যাধি

thumb|300px|ADHD আক্রান্ত মস্তিষ্কের স্ক্যান।

মনোযোগ ঘাটতি অতি সক্রিয়তা ব্যাধি (Attention Deficit Hyperactivity Disorder বা ADHD) একটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার। এটি সাধারণত শৈশবে শুরু হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এই ব্যাধিটি মনোযোগের অভাব, অতি সক্রিয়তা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা সৃষ্টি করে। ADHD মস্তিষ্কের কার্যকারিতার পার্থক্যের কারণে ঘটে থাকে এবং এর চিকিৎসায় ঔষধ, থেরাপি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন সহায়ক হতে পারে। এই নিবন্ধে ADHD-এর বিভিন্ন দিক, কারণ, লক্ষণ, নির্ণয়, চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রার উপর এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ADHD-এর প্রকারভেদ

ADHD প্রধানত তিনটি উপপ্রকার শ্রেণীবদ্ধ করা হয়:

মনোযোগ ঘাটতি প্রধান্য (Predominantly Inattentive Presentation): এই প্রকার ADHD-তে মনোযোগের অভাব প্রধান লক্ষণ। ব্যক্তি সহজেই মন বিক্ষিপ্ত করে ফেলে, কাজে ভুল করে এবং গুছিয়ে কাজ করতে সমস্যা অনুভব করে।
অতি সক্রিয়তা- আবেগপ্রবণতা প্রধান্য (Predominantly Hyperactive-Impulsive Presentation): এই প্রকার ADHD-তে অতি সক্রিয়তা এবং আবেগপ্রবণতা প্রধান লক্ষণ। ব্যক্তি অস্থির থাকে, কথা বলায় তাড়াহুড়ো করে এবং অন্যের কথা শোনার আগে উত্তর দেয়।
মিশ্রণ (Combined Presentation): এই প্রকার ADHD-তে মনোযোগের অভাব এবং অতি সক্রিয়তা- আবেগপ্রবণতা উভয় লক্ষণই দেখা যায়।

ADHD-এর কারণ

ADHD-এর সঠিক কারণ এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে জানা যায়নি, তবে মনে করা হয় যে জিনগত এবং পরিবেশগত কারণগুলোর একটি জটিল সমন্বয় এই ব্যাধি সৃষ্টি করে।

জিনগত কারণ: ADHD পরিবারে চলতে দেখা যায়, যা জিনগত প্রভাবের সম্ভাবনা নির্দেশ করে। যদি কোনো parent-এর ADHD থাকে, তাহলে সন্তানের মধ্যে এই ব্যাধি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতা: মস্তিষ্কের কিছু অংশের গঠন এবং কার্যকারিতার পার্থক্য ADHD-এর সাথে সম্পর্কিত। বিশেষ করে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (prefrontal cortex), যা মনোযোগ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশগত কারণ: গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্য, জন্মের সময় জটিলতা, শৈশবের আঘাত এবং পরিবেশ দূষণ ADHD-এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা: মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার, যেমন ডোপামিন (dopamine) এবং নরএপিনেফ্রিন (norepinephrine)-এর ভারসাম্যহীনতা ADHD-এর সাথে জড়িত।

ADHD-এর লক্ষণ

ADHD-এর লক্ষণগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে এবং বয়সের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে।

ADHD-এর লক্ষণ
মনোযোগের অভাব	অতি সক্রিয়তা	আবেগপ্রবণতা
সহজে মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া	অস্থিরতা, সবসময় নড়াচড়া করা	দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো, চিন্তা না করে কাজ করা
কাজে ভুল করা	শান্তভাবে বসতে অসুবিধা	অন্যের কথাinterruption করা
গুছিয়ে কাজ করতে সমস্যা হওয়া	অতিরিক্ত কথা বলা	অপেক্ষার সময় অধৈর্য হওয়া
কোনো কিছু শোনা বা মনে রাখতে অসুবিধা	ঝুঁকি নিতে পছন্দ করা	আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা
দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া	সবকিছুতে তাড়াহুড়ো করা	অল্পতেই হতাশ হয়ে যাওয়া

ADHD নির্ণয়

ADHD নির্ণয়ের জন্য কোনো একক পরীক্ষা নেই। সাধারণত, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা নিউরোলজিস্ট (neurologist) রোগীর ইতিহাস, আচরণ এবং লক্ষণগুলোর মূল্যায়ন করে ADHD নির্ণয় করেন। নির্ণয় প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:

শারীরিক পরীক্ষা: অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা বাতিল করার জন্য শারীরিক পরীক্ষা করা হয়।
মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন: রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য এবং আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
আচরণগত রেটিং স্কেল: শিক্ষক, parent এবং রোগীর কাছ থেকে আচরণগত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য রেটিং স্কেল ব্যবহার করা হয়। আচরণগত থেরাপি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
সাইকোএজিক্যাল পরীক্ষা: মনোযোগ, স্মৃতি এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা করা হয়।

ADHD-এর চিকিৎসা

ADHD-এর চিকিৎসায় সাধারণত ঔষধ, থেরাপি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত থাকে।

ঔষধ: ADHD-এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে ঔষধ বেশ কার্যকর। সাধারণত ব্যবহৃত ঔষধগুলো হলো:

   *   স্টিমুলেন্ট (Stimulants): মিথাইলফেনিডেট (methylphenidate) এবং অ্যামফেটামিন (amphetamine) মস্তিষ্কের ডোপামিন এবং নরএপিনেফ্রিন-এর মাত্রা বাড়িয়ে মনোযোগ এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
   *   নন-স্টিমুলেন্ট (Non-Stimulants): অ্যাটোমোক্সেটিন (atomoxetine) এবং গুয়ানফেসিন (guanfacine) মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

থেরাপি: থেরাপি ADHD-এর লক্ষণগুলো মোকাবেলা করতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক। কিছু সাধারণ থেরাপি হলো:

   *   বিহেভিয়ার থেরাপি (Behavior Therapy): এই থেরাপি অবাঞ্ছিত আচরণ কমাতে এবং ইতিবাচক আচরণ বাড়াতে সাহায্য করে।
   *   কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (Cognitive Behavioral Therapy বা CBT): এই থেরাপি নেতিবাচক চিন্তা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
   *   পারিবারিক থেরাপি (Family Therapy): এই থেরাপি পরিবারকে ADHD সম্পর্কে বুঝতে এবং সন্তানের সহায়তা করতে সাহায্য করে। পারিবারিক পরামর্শ এক্ষেত্রে খুব উপযোগী।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন: স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ADHD-এর লক্ষণগুলো কমাতে সহায়ক। এর মধ্যে রয়েছে:

   *   পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমানো প্রয়োজন।
   *   স্বাস্থ্যকর খাদ্য: সুষম খাদ্য গ্রহণ করা।
   *   নিয়মিত ব্যায়াম: শারীরিক কার্যকলাপ মনোযোগ এবং মেজাজ উন্নত করতে সহায়ক। শারীরিক স্বাস্থ্য এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ADHD এবং অন্যান্য অবস্থা

ADHD প্রায়শই অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে সহাবস্থান করে, যেমন:

উদ্বেগ (Anxiety): ADHD আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উদ্বেগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বিষণ্নতা (Depression): ADHD বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
লার্নিং ডিসঅর্ডার (Learning Disorders): ADHD-এর সাথে প্রায়ই ডিসলেক্সিয়া (dyslexia) এবং ডিসগ্রাফিয়ার (dysgraphia) মতো লার্নিং ডিসঅর্ডার দেখা যায়।
কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার (Conduct Disorder): কিছু ক্ষেত্রে ADHD কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারের সাথে যুক্ত থাকতে পারে।

ADHD-এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

ADHD-এর চিকিৎস না করা হলে এটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন:

শিক্ষাগত সমস্যা: পড়াশোনায় দুর্বলতা এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকি।
কর্মসংস্থান সমস্যা: চাকরি খুঁজে রাখতে অসুবিধা এবং কর্মজীবনে স্থবিরতা।
সম্পর্ক সমস্যা: বন্ধু এবং পরিবারের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে সমস্যা।
আইনগত সমস্যা: আবেগপ্রবণতার কারণে আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি।

ADHD-এর জন্য সহায়ক কৌশল

ADHD আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কিছু সহায়ক কৌশল নিচে উল্লেখ করা হলো:

সময় ব্যবস্থাপনা: সময়সূচী তৈরি করা এবং কাজগুলো ছোট ছোট অংশে ভাগ করা। সময় ব্যবস্থাপনার কৌশল এক্ষেত্রে সহায়ক।
সংগঠিত থাকা: জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা এবং একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করা।
মনোযোগ বৃদ্ধি করার কৌশল: মেডিটেশন (meditation) এবং মাইন্ডফুলনেস (mindfulness) অনুশীলন করা।
লক্ষ্য নির্ধারণ: বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং সেগুলো অর্জনের জন্য কাজ করা।
ইতিবাচক মনোভাব: নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং ইতিবাচক চিন্তা করা।

প্রযুক্তি ও ADHD

প্রযুক্তি ADHD আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক এবং ক্ষতিকর উভয়ই হতে পারে।

সহায়ক দিক:

   *   স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট: রিমাইন্ডার (reminder) এবং ক্যালেন্ডার (calendar) ব্যবহারের মাধ্যমে কাজ মনে রাখা এবং সময়সূচী অনুসরণ করা যায়।
   *   অ্যাপস (Apps): মনোযোগ বৃদ্ধি এবং কাজ সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন অ্যাপস পাওয়া যায়।
   *   শিক্ষামূলক গেমস: শেখার প্রক্রিয়াকে আরও আকর্ষণীয় এবং মজাদার করতে শিক্ষামূলক গেমস ব্যবহার করা যেতে পারে।

ক্ষতিকর দিক:

   *   অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম মনোযোগের অভাব এবং ঘুমের সমস্যা বাড়াতে পারে।
   *   সোশ্যাল মিডিয়া: সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ADHD নিয়ে গবেষণা

ADHD নিয়ে বর্তমানে প্রচুর গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা ADHD-এর কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসার নতুন উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। মস্তিষ্কের গবেষণা এবং জেনেটিক গবেষণা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

উপসংহার

মনোযোগ ঘাটতি অতি সক্রিয়তা ব্যাধি (ADHD) একটি জটিল নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার। সঠিক নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ADHD আক্রান্ত ব্যক্তিরা সফল এবং পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে। ঔষধ, থেরাপি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন ADHD-এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। ADHD সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

আরও জানতে:

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ