ভিয়েতনামের যুদ্ধ

ভূমিকা

ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং বিতর্কিত সংঘাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চলেছিল এবং এর মূল কারণ ছিল ভিয়েতনাম-এর কমিউনিস্ট উত্তর ভিয়েতনাম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিভেদ। এই যুদ্ধ শুধুমাত্র ভিয়েতনাম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

যুদ্ধের প্রেক্ষাপট

ভিয়েতনামের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে এর ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক পটভূমি আলোচনা করা প্রয়োজন। ভিয়েতনাম ফরাসি উপনিবেশ ছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কর্তৃক অধিকৃত হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে হো চি মিন ভিয়েতনামকে স্বাধীন ঘোষণা করেন, কিন্তু ফ্রান্স এটিকে পুনরায় নিজেদের দখলে নিতে চেষ্টা করে। এর ফলস্বরূপ, ইন্দোচীনীয় যুদ্ধ (১৯৪৬-১৯৫৪) শুরু হয়। এই যুদ্ধে ভিয়েত মিন নামক হো চি মিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বাহিনী ফরাসিদের পরাজিত করে।

১৯৫৪ সালের জেনেভা চুক্তি অনুসারে ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করা হয় এবং একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় একত্রিত করার কথা বলা হয়। কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে, এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে উত্তর ভিয়েতনাম এবং ভিয়েত কং (দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনী) দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারকে উৎখাত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করছিল। তারা বিশ্বাস করত যে কমিউনিজম-এর বিস্তার রোধ করতে হলে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে রক্ষা করা জরুরি। এই নীতিটি ছিল ডমিনো থিওরি-র উপর ভিত্তি করে, যেখানে বলা হয়েছিল যে একটি দেশ কমিউনিস্টদের দখলে গেলে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও একে একে কমিউনিস্ট হয়ে যাবে।

১৯৬৪ সালে টোনকিন উপসাগরের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত তৈরি করে। মার্কিন কংগ্রেস টোনকিন রেজোলিউশন পাস করে, যা প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন-কে ভিয়েতনামে সামরিক শক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা দেয়। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক বোমা হামলা শুরু করে এবং স্থলসেনা প্রেরণ করে।

যুদ্ধের পর্যায়ক্রম

ভিয়েতনামের যুদ্ধকে কয়েকটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়:

১৯৫৫-১৯৬৪: সীমিত পরিসরে মার্কিন সহায়তা এবং ভিয়েত কং-এর গেরিলা কার্যক্রম।
১৯৬৫-১৯৬৮: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সামরিক হস্তক্ষেপ এবং যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি। এই সময়কালে অপারেশন রোলিং থান্ডার-এর মতো বড় আকারের বোমা হামলা চালানো হয়।
১৯৬৯-১৯৭১: ভিয়েতনাইজেশন নীতি গ্রহণ, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের দায়িত্ব অর্পণ করে।
১৯৭২-১৯৭৫: উত্তর ভিয়েতনামের চূড়ান্ত আক্রমণ এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতন।

ভিয়েতনামের যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
বছর	ঘটনা		১৯৫৪	জেনেভা চুক্তি ও ভিয়েতনামের বিভাজন		১৯৬৪	টোনকিন উপসাগরের ঘটনা		১৯৬৫	মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু		১৯৬৮	টেট আক্রমণ		১৯৭১	কম্বোডিয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান		১৯৭৩	প্যারিস শান্তি চুক্তি		১৯৭৫	সাইগনের পতন ও ভিয়েতনামের একত্রীকরণ

গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধসমূহ

ভিয়েতনামের যুদ্ধ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এবং অভিযানের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়:

ডিয়েন Bien ফু (১৯৫৪): ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ভিয়েত মিনের চূড়ান্ত বিজয়, যা ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটায়।
টেট আক্রমণ (১৯৬৮): ভিয়েত কং এবং উত্তর ভিয়েতনামের যৌথ আক্রমণ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল।
মায় লাই গণহত্যা (১৯৬८): মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত একটি বিতর্কিত ঘটনা, যেখানে বহু বেসামরিক ভিয়েতনামিকে হত্যা করা হয়েছিল।
কম্বোডিয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান (১৯৭১): কমিউনিস্ট ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য কম্বোডিয়ার অভ্যন্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান।

যুদ্ধের কৌশল ও প্রযুক্তি

ভিয়েতনামের যুদ্ধে উভয় পক্ষই বিভিন্ন ধরনের কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক বিমান, হেলিকপ্টার, বোমা এবং রাসায়নিক অস্ত্র (যেমন এজেন্ট অরেঞ্জ) ব্যবহার করে। অন্যদিকে, ভিয়েত কং গেরিলা যুদ্ধের উপর নির্ভর করে, যেখানে তারা স্থানীয় জনগণের সমর্থন লাভ করে এবং ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে আক্রমণ চালাত।

গেরিলা যুদ্ধ: ভিয়েত কং-এর প্রধান কৌশল ছিল গেরিলা যুদ্ধ, যেখানে ছোট ছোট দল অতর্কিত হামলা চালাতো।
সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশল, যেখানে সৈন্যদের পাঠানো হতো সন্দেহভাজন এলাকায় অনুসন্ধান এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য।
এয়ার পাওয়ার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক বিমান হামলার মাধ্যমে উত্তর ভিয়েতনাম এবং ভিয়েত কং-এর সরবরাহ লাইন ধ্বংস করার চেষ্টা করে।
টানেল ওয়ারফেয়ার: ভিয়েত কং সৈন্যদের জন্য নির্মিত জটিল টানেলের নেটওয়ার্ক, যা তাদের লুকিয়ে থাকতে এবং আক্রমণ চালাতে সাহায্য করত।

প্যারিস শান্তি চুক্তি ও যুদ্ধের সমাপ্তি

১৯৭১ সাল থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় এবং সরকার উপর চাপ সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিসে উত্তর ভিয়েতনাম এবং ভিয়েত কং-এর সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করে।

১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু চুক্তি সত্ত্বেও, উত্তর ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে।

১৯৭৫ সালের ৩০শে এপ্রিল উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্যরা সাইগন দখল করে নেয়, যার ফলে দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারের পতন হয় এবং ভিয়েতনাম আনুষ্ঠানিকভাবে একত্রিত হয়।

যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব

ভিয়েতনামের যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এই যুদ্ধে প্রায় ২০ লক্ষ ভিয়েতনামি নাগরিক এবং ৫৮ হাজার মার্কিন সৈন্য নিহত হয়।

ভিয়েতনামের একত্রীকরণ: উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একত্রিত হয়ে কমিউনিস্ট ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর প্রভাব: এই যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভেদ সৃষ্টি করে এবং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: ভিয়েতনামের যুদ্ধ ঠান্ডা যুদ্ধ-এর গতিপথ পরিবর্তন করে এবং কমিউনিস্ট চীনের প্রভাব বৃদ্ধি করে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন: যুদ্ধে উভয় পক্ষই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়।