ব্র্যাক

ব্র্যাক : একটি বিস্তারিত আলোচনা

ভূমিকা

ব্র্যাক (Building Resources Across Communities) বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়ন সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম। এটি বাংলাদেশ থেকে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, এবং সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে। ব্র্যাকের কাজের পরিধি, কৌশল, এবং প্রভাব নিয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

ব্র্যাকের প্রেক্ষাপট ও প্রতিষ্ঠা

ব্র্যাক ১৯৭২ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞ এবং দারিদ্র্যপীড়িত পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্র্যাকের যাত্রা শুরু। শুরুতে এটি বাংলাদেশ রিমোট এরিয়া রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (BARDS) নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে এর নাম পরিবর্তন করে ব্র্যাক রাখা হয়।

ব্র্যাকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

ব্র্যাকের প্রধান লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন এবং সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্র্যাক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:

দারিদ্র্য হ্রাস করা
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধি করা
কৃষি ও জীবিকা বহুমুখীকরণ
নারীর ক্ষমতায়ন
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা
সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা

ব্র্যাকের কর্মপরিধি

ব্র্যাকের কর্মপরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত। এটি মূলত ছয়টি প্রধান ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করে:

ব্র্যাকের কর্মক্ষেত্র
ক্ষেত্র	কার্যক্রম	উদাহরণ
উন্নয়ন কর্মসূচি	দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা	অতি দরিদ্রদের জন্য সহায়তা কর্মসূচি, প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কৃষি প্রশিক্ষণ	মাইক্রোফাইন্যান্স	ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান, সঞ্চয় কর্মসূচি, বীমা সেবা	দরিদ্র নারীদের ঋণ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন	সামাজিক উদ্যোগ	সামাজিক ব্যবসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ	ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক হেলথ কেয়ার	অ্যাডভোকেসি ও গবেষণা	নীতি নির্ধারণে প্রভাব সৃষ্টি, উন্নয়ন সমস্যা নিয়ে গবেষণা	মানবাধিকার বিষয়ক গবেষণা, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অ্যাডভোকেসি	মানবিক সহায়তা	দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম	বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা	আন্তর্জাতিক কার্যক্রম	অন্যান্য দেশে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন	আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম

ব্র্যাকের কৌশল ও পদ্ধতি

ব্র্যাক তার কর্মসূচি বাস্তবায়নে কিছু বিশেষ কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন: স্থানীয় জনগণকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত করা এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।
সমন্বিত উন্নয়ন: বিভিন্ন খাতের কর্মসূচিকে সমন্বিত করে বাস্তবায়ন করা, যাতে একটি খাতের উন্নয়ন অন্য খাতের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
টার্গেটেড প্রোগ্রাম: নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা, যেমন - নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ইত্যাদি।
প্রযুক্তি ব্যবহার: উন্নয়ন কাজে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা, যেমন - মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শিক্ষা, কৃষি তথ্য সেবা ইত্যাদি।
মনিটরিং ও মূল্যায়ন: কর্মসূচির নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা, যাতে কার্যক্রমের কার্যকারিতা যাচাই করা যায় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন আনা যায়।

ব্র্যাকের প্রধান কর্মসূচি

ব্র্যাক বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা করে। এর মধ্যে কিছু প্রধান কর্মসূচি নিচে উল্লেখ করা হলো:

দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি: এই কর্মসূচির মাধ্যমে অতি দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ, এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
শিক্ষা কর্মসূচি: ব্র্যাক প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর জন্য কাজ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্র্যাকের প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
স্বাস্থ্য কর্মসূচি: ব্র্যাক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, রোগ প্রতিরোধ, এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে। এর মধ্যে রয়েছে ব্র্যাক হেলথ কেয়ার, যা দেশের অন্যতম বৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।
কৃষি ও জীবিকা কর্মসূচি: এই কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, বীজ, সার, এবং ঋণ সহায়তা প্রদান করা হয়। এছাড়াও, ব্র্যাক বিভিন্ন ধরনের আয় উৎপাদনমূলক কাজে সহায়তা করে।
জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি: ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষা, এবং জলবায়ু সহনশীল কৃষি।
মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচি: ব্র্যাক বিশ্বের বৃহত্তম মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম। এটি দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনে সহায়তা করে।

ব্র্যাকের সাফল্য ও প্রভাব

ব্র্যাক তার দীর্ঘ পথচলায় দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এর কিছু প্রধান প্রভাব হলো:

দারিদ্র্য হ্রাস: ব্র্যাকের কর্মসূচিগুলি লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক হয়েছে।
শিক্ষার বিস্তার: ব্র্যাকের শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেক শিশু শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন: ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উন্নতি হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়ন: ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী হয়েছে।
দুর্যোগ মোকাবেলা: ব্র্যাক দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দ্রুত ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করে অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।

ব্র্যাকের চ্যালেঞ্জসমূহ

ব্র্যাক বর্তমানে কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

অর্থায়ন সংকট: উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থের অভাব।
রাজনৈতিক অস্থিরতা: রাজনৈতিক অস্থিরতা কর্মসূচির বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে।
জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নয়ন কার্যক্রম কঠিন হয়ে পড়ে।
কোভিড-১৯ মহামারী: কোভিড-১৯ মহামারী ব্র্যাকের অনেক কর্মসূচিকে ব্যাহত করেছে এবং নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা: আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্র্যাকের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে।

ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ব্র্যাক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে কিছু নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি: উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও দ্রুত এবং কার্যকর করার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো।
সামাজিক ব্যবসার প্রসার: সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের নতুন পথ তৈরি করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় আরও বেশি বিনিয়োগ: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কার্যক্রম সম্প্রসারণ: অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে ব্র্যাকের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।
অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি: স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, সরকার, এবং বেসরকারি খাতের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো।

ব্র্যাক ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG)

ব্র্যাক জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals - SDG) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্র্যাকের অধিকাংশ কর্মসূচি SDGs-এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। বিশেষ করে, দারিদ্র্য দূরীকরণ (SDG 1), শিক্ষা (SDG 4), স্বাস্থ্য (SDG 3), লিঙ্গ সমতা (SDG 5), এবং জলবায়ু কার্যক্রম (SDG 13) -এর ক্ষেত্রে ব্র্যাকের অবদান উল্লেখযোগ্য।

ব্র্যাকের উপর সমালোচনা

ব্র্যাকের কাজের কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনাও রয়েছে। কেউ কেউ ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রমের উচ্চ সুদের হার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আবার কেউ কেউ ব্র্যাকের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের কারণে এর দাতব্য উদ্দেশ্য থেকে সরে যাওয়ার অভিযোগ করেন। তবে, ব্র্যাক সবসময় তার কাজের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বজায় রাখার চেষ্টা করে।

উপসংহার

ব্র্যাক একটি সফল উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং সামাজিক উন্নয়নে ব্র্যাকের অবদান অনস্বীকার্য। সংস্থাটি ভবিষ্যতে আরও নতুন কৌশল ও পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করে তুলবে এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। ব্র্যাকের অভিজ্ঞতা এবং সাফল্য অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার জন্য একটি মডেল হতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি দারিদ্র্য উন্নয়ন ক্ষুদ্রঋণ শিক্ষা স্বাস্থ্য জলবায়ু পরিবর্তন টেকসই উন্নয়ন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ব্র্যাক হেলথ কেয়ার অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন সামাজিক ব্যবসা ডিজিটাল প্রযুক্তি জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশের ইতিহাস স্যার ফজলে হাসান আবেদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নারীর ক্ষমতায়ন কৃষি মাইক্রোফাইন্যান্স

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ