বিষয়:ইতিহাস

ইতিহাস

ভূমিকা

ইতিহাস মানব সমাজের পরিবর্তনের বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন। এটি অতীত ঘটনা, আবিষ্কার, এবং মানবজাতির বিবর্তনের ধারা নিয়ে আলোচনা করে। ইতিহাস শুধু অতীতের কাহিনী নয়, বরং বর্তমানকে বুঝতে এবং ভবিষ্যৎ গড়তে এর তাৎপর্য অপরিহার্য। ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণে, ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, বিশ্লেষণ করে এবং ব্যাখ্যা করে অতীতের একটি সামগ্রিক চিত্র তৈরি করেন।

ইতিহাসের সংজ্ঞা ও পরিধি

ইতিহাস শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘হিস্টোরিয়া’ (ἱστορία) থেকে এসেছে, যার অর্থ অনুসন্ধান বা তদন্ত। সাধারণভাবে, ইতিহাস বলতে অতীতের ঘটনাবলিকে বোঝায়, কিন্তু এর পরিধি অনেক বিস্তৃত। ইতিহাস শুধু রাজনৈতিক ঘটনা বা রাজাদের বংশতালিকা নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনগুলিও এর অন্তর্ভুক্ত।

ইতিহাসের পরিধিকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়:

রাজনৈতিক ইতিহাস: রাষ্ট্র, সরকার, যুদ্ধ, বিপ্লব, এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উত্থান-পতন নিয়ে আলোচনা করে।
সামাজিক ইতিহাস: সমাজের গঠন, শ্রেণিভেদ, প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, এবং মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে।
অর্থনৈতিক ইতিহাস: উৎপাদন, বিতরণ, বিনিময়, এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে। অর্থনীতি
সাংস্কৃতিক ইতিহাস: শিল্পকলা, সাহিত্য, সঙ্গীত, ধর্ম, দর্শন, এবং মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে। সংস্কৃতি
ধর্মীয় ইতিহাস: বিভিন্ন ধর্ম এবং তাদের অনুসারীদের বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, এবং সমাজের উপর তাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে। ধর্ম

ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব

ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে উল্লেখ করা হলো:

অতীত থেকে শিক্ষা: ইতিহাস থেকে আমরা অতীত ভুলগুলো সম্পর্কে জানতে পারি এবং ভবিষ্যতে সেগুলো এড়িয়ে চলতে পারি।
জাতীয়তাবোধের বিকাশ: ইতিহাস একটি জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং বীরত্বগাথা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে, যা জাতীয়তাবোধের বিকাশে সহায়ক। জাতীয়তাবাদ
সমস্যা সমাধানে সহায়ক: অতীতের ঘটনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানে নতুন ধারণা পেতে পারি।
মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ: ইতিহাস বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়, যা মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে সহায়ক।
চিন্তাশক্তি ও বিচারবুদ্ধির বিকাশ: ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার মাধ্যমে আমাদের চিন্তাশক্তি ও বিচারবুদ্ধি বৃদ্ধি পায়।

ইতিহাসের উৎস

ইতিহাস লেখার জন্য ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন ধরনের উৎস ব্যবহার করেন। এই উৎসগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:

১. প্রাথমিক উৎস: যে উৎসগুলো ঘটনার সময়কালে তৈরি হয়েছিল, সেগুলো হলো প্রাথমিক উৎস। যেমন -

নথিপত্র: সরকারি আদেশ, চুক্তিপত্র, ব্যক্তিগত চিঠি, ডায়েরি ইত্যাদি। নথিপত্র
স্থাপত্য: মন্দির, মসজিদ, দুর্গ, প্রাসাদ, এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপত্য। স্থাপত্য
শিল্পকর্ম: মূর্তি, চিত্রকর্ম, এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম। শিল্পকলা
মুদ্রা ও শিলালিপি: প্রাচীন মুদ্রা এবং শিলালিপি থেকে তৎকালীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ধারণা পাওয়া যায়। মুদ্রা শিলালিপি
ভ্রমণকাহিনী: পর্যটকদের লেখা ভ্রমণকাহিনী থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক অবস্থার বিবরণ জানা যায়।

২. মাধ্যমিক উৎস: যে উৎসগুলো প্রাথমিক উৎস থেকে তথ্য নিয়ে লেখা হয়েছে, সেগুলো হলো মাধ্যমিক উৎস। যেমন -

ইতিহাসের বই: ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ।
জীবনী: বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবন কাহিনী। জীবনী
পর্যালোচনা প্রবন্ধ: ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুর উপর লেখা গবেষণা প্রবন্ধ।
সংবাদপত্র ও সাময়িকী: অতীতের সংবাদপত্র এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদন।

ঐতিহাসিকগণ উভয় প্রকার উৎস ব্যবহার করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করেন এবং একটি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনা করেন।

ইতিহাসের কালক্রম

ইতিহাসকে সাধারণত নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা হয়:

প্রাচীন ইতিহাস: খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩৫০০ থেকে খ্রিস্টীয়াব্দ ৫০০ পর্যন্ত সময়কাল। এই সময়ে মিশর, মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, রোম, এবং ভারতীয় সভ্যতাগুলোর বিকাশ ঘটে। প্রাচীন মিশর মেসোপটেমিয়া প্রাচীন গ্রিস রোমান সাম্রাজ্য সিন্ধু সভ্যতা
মধ্যযুগীয় ইতিহাস: খ্রিস্টীয়াব্দ ৫০০ থেকে ১৫০০ পর্যন্ত সময়কাল। এই সময়ে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ, ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তার, এবং ক্রুসেডের মতো ঘটনা ঘটে। সামন্ততন্ত্র ইসলামি সাম্রাজ্য ক্রুসেড
আধুনিক ইতিহাস: খ্রিস্টীয়াব্দ ১৫০০ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত সময়কাল। এই সময়ে রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব, এবং শিল্প বিপ্লবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো ঘটে। রেনেসাঁস ধর্ম সংস্কার বৈজ্ঞানিক বিপ্লব শিল্প বিপ্লব
সমসাময়িক ইতিহাস: খ্রিস্টীয়াব্দ ১৯০০ থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কাল। এই সময়ে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ঠান্ডা যুদ্ধ, এবং বিশ্বায়নের মতো ঘটনা ঘটেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠান্ডা যুদ্ধ বিশ্বায়ন

ঐতিহাসিক পদ্ধতি

ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য ঐতিহাসিকগণ কিছু সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এই পদ্ধতিগুলো হলো:

উৎস সংগ্রহ: ঘটনার সম্পর্কিত বিভিন্ন উৎস সংগ্রহ করা।
উৎস সমালোচনা: সংগৃহীত উৎসগুলোর সত্যতা যাচাই করা।
তথ্য বিশ্লেষণ: উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ঘটনার একটি coherent চিত্র তৈরি করা।
ব্যাখ্যা: বিশ্লেষণের ফলাফলের ভিত্তিতে ঘটনার একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেওয়া।
রচনা: সংগৃহীত তথ্য, বিশ্লেষণ, এবং ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ইতিহাস রচনা করা।

ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ইতিহাসকে একটি বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তির উপর স্থাপন করা হয়।

ইতিহাসের বিভিন্ন শাখা

ইতিহাসের বিভিন্ন শাখা রয়েছে, যা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে বিশেষ মনোযোগ দেয়। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শাখা হলো:

রাজনৈতিক ইতিহাস: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, ঘটনা এবং নেতাদের নিয়ে আলোচনা করে।
অর্থনৈতিক ইতিহাস: অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বাণিজ্য, এবং আর্থিক লেনদেন নিয়ে আলোচনা করে।
সামাজিক ইতিহাস: সমাজের গঠন, প্রথা, এবং মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে।
সাংস্কৃতিক ইতিহাস: শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, এবং ধর্ম নিয়ে আলোচনা করে।
সামরিক ইতিহাস: যুদ্ধ, সামরিক কৌশল, এবং সামরিক নেতাদের নিয়ে আলোচনা করে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইতিহাস: বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং সমাজের উপর তাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে।
পরিবেশগত ইতিহাস: মানুষ এবং পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক এবং পরিবেশের পরিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে।

ঐতিহাসিকদের অবদান

বিভিন্ন সময়ে অনেক ঐতিহাসিক তাঁদের কাজের মাধ্যমে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের উল্লেখযোগ্য অবদান নিচে উল্লেখ করা হলো:

হেরোডোটাস: তাঁকে "ইতিহাসের জনক" বলা হয়। তিনি গ্রিক-পারস্য যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
থুকিডিডিস: তিনি পেলোপনেশীয় যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেন এবং ঐতিহাসিক গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করেন।
ইবনে খলদুন: তিনি "মুকাদ্দিমা" নামক গ্রন্থে ইতিহাসের একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
র‍্যাঙ্ক: তিনি আধুনিক ঐতিহাসিক পদ্ধতির প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত।
মার্ক ব্লোক: তিনি "মেন্টালিটিস" বা collective mindset নিয়ে গবেষণা করেছেন।
কার্ল মার্ক্স: তিনি ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। কার্ল মার্ক্স
আর্নল্ড টয়েনবি: তিনি সভ্যতার উত্থান-পতন নিয়ে গবেষণা করেছেন।

উপসংহার

ইতিহাস মানবজাতির পথচলার প্রতিচ্ছবি। এটি আমাদের অতীতকে জানতে, বর্তমানকে বুঝতে এবং ভবিষ্যৎকে গড়তে সহায়ক। ইতিহাসের সঠিক অধ্যয়ন এবং বিশ্লেষণ একটি উন্নত সমাজ গঠনে অপরিহার্য। সামাজিক উন্নয়ন

ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শাখা
শাখা	বিষয়বস্তু	উদাহরণ
রাজনৈতিক ইতিহাস	রাষ্ট্র, সরকার, যুদ্ধ	প্রাচীন রোমের রাজনৈতিক কাঠামো
অর্থনৈতিক ইতিহাস	বাণিজ্য, উৎপাদন, বিনিময়	শিল্প বিপ্লবের অর্থনৈতিক প্রভাব
সামাজিক ইতিহাস	শ্রেণি, প্রথা, জীবনযাত্রা	মধ্যযুগের ইউরোপের সামাজিক ব্যবস্থা
সাংস্কৃতিক ইতিহাস	শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম	রেনেসাঁর সাহিত্য ও শিল্পকলা
সামরিক ইতিহাস	যুদ্ধ, কৌশল, সেনা	দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামরিক কৌশল

আরও দেখুন

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ