প্রোস্পেক্ট থিওরি

প্রোস্পেক্ট থিওরি : বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এর প্রেক্ষাপট

ভূমিকা প্রোস্পেক্ট থিওরি আচরণগত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। প্রথাগত অর্থনীতির যুক্তিবাদী মডেল থেকে এটি একটি উল্লেখযোগ্য বিচ্যুতি। প্রথাগত অর্থনীতি ধরে নেয় বিনিয়োগকারীরা যুক্তিবাদী এবং ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা সবসময় নিজেদের উপযোগিতা (utility) সর্বাধিক করতে চায়। কিন্তু প্রোস্পেক্ট থিওরি অনুযায়ী, মানুষ সাধারণত লাভের চেয়ে ক্ষতির প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মানসিক পক্ষপাতদুষ্টতা (cognitive biases) দ্বারা প্রভাবিত হয়। বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে এই থিওরির প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উচ্চ ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে। এই নিবন্ধে প্রোস্পেক্ট থিওরির মূল ধারণা, বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে এর প্রভাব এবং কিভাবে এই তত্ত্ব ব্যবহার করে ট্রেডাররা নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া উন্নত করতে পারে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।

প্রোস্পেক্ট থিওরির মূল ধারণা প্রোস্পেক্ট থিওরি ১৯৭৯ সালে ড্যানিয়েল Kahneman এবং Amos Tversky দ্বারা প্রস্তাবিত হয়। এই তত্ত্বের মূল ভিত্তিগুলো হলো:

১. মূল্য সংবেদনশীলতা (Value Sensitivity): মানুষ কোনো জিনিস পাওয়ার চেয়ে হারানোর প্রতি বেশি সংবেদনশীল। অর্থাৎ, একই পরিমাণ লাভ এবং ক্ষতির ক্ষেত্রে ক্ষতির অনুভূতি লাভের চেয়ে তীব্র হয়। এই কারণে, বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে বেশি আগ্রহী হন।

২. রেফারেন্স পয়েন্ট (Reference Point): মানুষ তাদের সিদ্ধান্তগুলো একটি নির্দিষ্ট রেফারেন্স পয়েন্টের সাপেক্ষে মূল্যায়ন করে। এই রেফারেন্স পয়েন্ট সাধারণত তাদের বর্তমান অবস্থা বা প্রত্যাশিত ফলাফল হয়ে থাকে। লাভের হিসাব করা হয় রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে কতটা বেশি পাওয়া গেছে, আর ক্ষতির হিসাব করা হয় রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে কতটা কম পাওয়া গেছে।

৩. হ্রাসশীল সংবেদনশীলতা (Diminishing Sensitivity): লাভের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে লাভের অনুভূতি ধীরে ধীরে কমে যায়, তেমনি ক্ষতির পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে ক্ষতির অনুভূতিও ধীরে ধীরে কমে যায়। এর মানে হলো, প্রথম $১০০ লাভ করা যেমন আনন্দদায়ক, তেমনি প্রথম $১০০ হারানোও তেমনই বেদনাদায়ক, কিন্তু $১০০০ লাভ বা ক্ষতির ক্ষেত্রে এই অনুভূতি তীব্রতা কম থাকে।

৪. সম্ভাব্যতা ওজন (Probability Weighting): মানুষ সম্ভাব্যতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না। তারা কম সম্ভাবনার ঘটনাকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং উচ্চ সম্ভাবনার ঘটনাকে কম গুরুত্ব দেয়।

বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে প্রোস্পেক্ট থিওরির প্রভাব বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে প্রোস্পেক্ট থিওরির প্রভাব অনেক গভীর। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আলোচনা করা হলো:

১. ক্ষতির ভয় (Loss Aversion): বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে ট্রেডাররা প্রায়ই ক্ষতির ভয়ে তাড়িত হন। প্রোস্পেক্ট থিওরি অনুযায়ী, ক্ষতির অনুভূতি লাভের চেয়ে বেশি তীব্র হওয়ায় ট্রেডাররা দ্রুত লোকসান বন্ধ করার জন্য আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এর ফলে তারা ভুল সময়ে অপশন বিক্রি করে দিতে পারেন বা অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতে পারেন। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

২. ব্রেক-ইভেন পয়েন্টের প্রতি আকর্ষণ (Attraction to the Break-Even Point): ট্রেডাররা তাদের বিনিয়োগের ব্রেক-ইভেন পয়েন্টের কাছাকাছি এলে অপশন ধরে রাখার প্রবণতা দেখান, এমনকি যদি ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি থাকে। এটি প্রোস্পেক্ট থিওরির রেফারেন্স পয়েন্টের ধারণার সাথে সম্পর্কিত। ট্রেডাররা তাদের প্রারম্ভিক বিনিয়োগের নিচে যেতে চান না, তাই তারা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অপশন ধরে রাখেন।

৩. হাউজ মানি এফেক্ট (House Money Effect): যখন ট্রেডাররা পূর্বে অর্জিত লাভ থেকে ট্রেড করেন, তখন তারা বেশি ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত হন। কারণ তারা মনে করেন যে তারা "হাউস মানি" দিয়ে ট্রেড করছেন, যা তাদের আসল বিনিয়োগের অংশ নয়। এই কারণে, তারা যুক্তিবাদী ঝুঁকি মূল্যায়ন ছাড়াই বড় আকারের ট্রেড করতে পারেন। মানি ম্যানেজমেন্ট এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।

৪. উপলব্ধতারheuristic (Availability Heuristic): ট্রেডাররা সাম্প্রতিক বা সহজে মনে পড়তে পারে এমন তথ্যের উপর বেশি নির্ভর করেন। যদি তারা সম্প্রতি কিছু সফল ট্রেড করে থাকেন, তবে তারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে যেতে পারেন এবং বেশি ঝুঁকি নিতে পারেন। আবার, যদি তারা लगातार লোকসান সম্মুখীন হন, তবে তারা হতাশ হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ এর মাধ্যমে এই bias কমানো যায়।

৫. নিশ্চিততা প্রভাব (Certainty Effect): ট্রেডাররা একটি নিশ্চিত ফলাফলকে একটি সম্ভাব্য ফলাফলের চেয়ে বেশি মূল্য দেন, এমনকি যদি সম্ভাব্য ফলাফলের প্রত্যাশিত মান বেশি হয়। বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে, যেখানে ফলাফল হয় লাভ অথবা ক্ষতি, সেখানে ট্রেডাররা নিশ্চিত লাভের জন্য সামান্য সুযোগও নিতে দ্বিধা করেন না।

প্রোস্পেক্ট থিওরি ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া উন্নত করার উপায় প্রোস্পেক্ট থিওরির জ্ঞান ব্যবহার করে ট্রেডাররা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে উন্নত করতে পারেন। নিচে কিছু উপায় আলোচনা করা হলো:

১. মানসিক সচেতনতা (Emotional Awareness): ট্রেডারদের তাদের আবেগ এবং মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। যখন তারা ক্ষতির ভয়ে বা লাভের আশায় তাড়িত হন, তখন তাদের বুঝতে হবে যে তারা প্রোস্পেক্ট থিওরির প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন।

২. সুনির্দিষ্ট ট্রেডিং পরিকল্পনা (Defined Trading Plan): একটি সুনির্দিষ্ট ট্রেডিং পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। এই পরিকল্পনাতে ঝুঁকির মাত্রা, লাভের লক্ষ্য এবং ক্ষতির সীমা নির্ধারণ করা উচিত। ট্রেডিং স্ট্র্যাটেজি তৈরি এবং অনুসরণ করা এক্ষেত্রে খুব দরকারি।

৩. ছোট আকারের ট্রেড (Small Trade Sizes): বড় আকারের ট্রেড না করে ছোট আকারের ট্রেড করা উচিত। এতে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে এবং ট্রেডাররা আবেগপ্রবণ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।

৪. স্টপ-লস অর্ডার ব্যবহার (Use Stop-Loss Orders): স্টপ-লস অর্ডার ব্যবহার করে ট্রেডাররা তাদের সম্ভাব্য ক্ষতি সীমিত করতে পারেন। এটি তাদের ক্ষতির ভয় কমাতে এবং আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করে।

৫. লাভের লক্ষ্য নির্ধারণ (Set Profit Targets): লাভের লক্ষ্য নির্ধারণ করে ট্রেডাররা তাদের লাভ নিশ্চিত করতে পারেন এবং অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন।

৬. ডায়েরি লেখা (Trading Diary): ট্রেডিং ডায়েরি লেখার মাধ্যমে ট্রেডাররা তাদের ট্রেডিংয়ের ভুলগুলো চিহ্নিত করতে পারেন এবং ভবিষ্যতে সেগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন।

৭. নিয়মিত বিরতি (Regular Breaks): ট্রেডিংয়ের সময় নিয়মিত বিরতি নেওয়া উচিত। এতে মানসিক চাপ কমবে এবং ট্রেডাররা শান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

৮. বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন (Diversification): শুধুমাত্র একটি কৌশলের উপর নির্ভর না করে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা উচিত। ডাইভারসিফিকেশন ঝুঁকির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

৯. পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন (Review and Evaluation): নিয়মিতভাবে ট্রেডিংয়ের ফলাফল পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন করা উচিত।

বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ের জন্য অতিরিক্ত কিছু কৌশল বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে সাফল্যের জন্য প্রোস্পেক্ট থিওরির পাশাপাশি আরও কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে:

১. টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ (Technical Analysis): টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ ব্যবহার করে মার্কেটের গতিবিধি এবং সম্ভাব্য প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

২. ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ (Fundamental Analysis): ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সূচক এবং কোম্পানির আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন করা যায়।

৩. ভলিউম বিশ্লেষণ (Volume Analysis): ভলিউম বিশ্লেষণ ব্যবহার করে মার্কেটের চাহিদা এবং যোগান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

৪. রিস্ক রিওয়ার্ড রেশিও (Risk-Reward Ratio): প্রতিটি ট্রেডের জন্য রিস্ক রিওয়ার্ড রেশিও মূল্যায়ন করা উচিত।

৫. মার্কেট সেন্টিমেন্ট (Market Sentiment): মার্কেট সেন্টিমেন্ট বিশ্লেষণ করে মার্কেটের সামগ্রিক মনোভাব বোঝা যায়।

৬. নিউজ এবং ইভেন্ট (News and Events): গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নিউজ এবং ইভেন্টগুলি মার্কেটের উপর প্রভাব ফেলে, তাই সেগুলোর দিকে নজর রাখা উচিত।

উপসংহার প্রোস্পেক্ট থিওরি বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই তত্ত্বটি বিনিয়োগকারীদের মানসিক পক্ষপাতদুষ্টতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। ট্রেডাররা যদি প্রোস্পেক্ট থিওরির মূল ধারণাগুলো বুঝতে পারেন এবং তাদের ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারেন, তবে তারা তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়াতে পারেন। এছাড়াও, সঠিক ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম নির্বাচন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা সম্পর্কে অবগত থাকাটাও জরুরি। পরিশেষে, মনে রাখতে হবে যে বাইনারি অপশন ট্রেডিং ঝুঁকিপূর্ণ, তাই সতর্কতার সাথে ট্রেড করা উচিত।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ