প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার
প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার
প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার (পিএলসি) কি?
প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার (পিএলসি) হলো একটি বিশেষায়িত কম্পিউটার যা শিল্পখাতে বিভিন্ন প্রকার ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত জটিল স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াগুলির জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। পিএলসি-র মূল কাজ হলো ইনপুট ডিভাইস থেকে সংকেত গ্রহণ করা, সেই অনুযায়ী প্রোগ্রামিং করা লজিক ব্যবহার করে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করা এবং আউটপুট ডিভাইসকে নির্দেশ দেওয়া। এই আউটপুট ডিভাইসগুলো মোটর, ভালভ, পাম্প, এবং অন্যান্য শিল্প সরঞ্জামকে নিয়ন্ত্রণ করে।
পিএলসি-র ইতিহাস
পিএলসি-র ইতিহাস ১৯৫০-এর দশকে শুরু হয়, যখন জেনারেল মোটরস তাদের স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলির জন্য নির্ভরযোগ্য এবং প্রোগ্রামযোগ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খুঁজছিল। সেই সময়কার রিলে-ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো ছিল জটিল, ব্যয়বহুল এবং পরিবর্তন করা কঠিন। ১৯৬০-এর দশকে, মডিউলার ডিজিটাল ইলেকট্রনিক সিস্টেমের উদ্ভাবন পিএলসি-র বিকাশের পথ খুলে দেয়। প্রথম পিএলসি তৈরি করে Modicon (বর্তমানে Schneider Electric)। ১৯৮০-এর দশকে, পিএলসি প্রযুক্তি আরও উন্নত হয় এবং ছোট আকারের, কম দামের পিএলসি পাওয়া যায়, যা এটিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। বর্তমানে, পিএলসি শিল্পখাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ।
পিএলসি-র গঠন
একটি পিএলসি সাধারণত নিম্নলিখিত অংশগুলো নিয়ে গঠিত:
- সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ): এটি পিএলসি-র মস্তিষ্ক, যা প্রোগ্রামের নির্দেশাবলী চালায় এবং সমস্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।
- মেমরি: সিপিইউ প্রোগ্রাম, ডেটা এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণের জন্য মেমরি ব্যবহার করে। বিভিন্ন ধরনের মেমরি রয়েছে, যেমন র্যাম (RAM), রম (ROM), এবং ইইPROM (EEPROM)।
- ইনপুট মডিউল: এই মডিউলগুলো সেন্সর, সুইচ এবং অন্যান্য ইনপুট ডিভাইস থেকে সংকেত গ্রহণ করে।
- আউটপুট মডিউল: এই মডিউলগুলো মোটর, ভালভ, লাইট এবং অন্যান্য আউটপুট ডিভাইসকে নিয়ন্ত্রণ করে।
- পাওয়ার সাপ্লাই: পিএলসি-কে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
- প্রোগ্রামিং ডিভাইস: পিএলসি প্রোগ্রাম করার জন্য কম্পিউটার বা প্রোগ্রামিং টার্মিনাল ব্যবহার করা হয়।
| উপাদান | কাজ | সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ) | প্রোগ্রামের নির্দেশাবলী চালায় এবং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে | মেমরি | প্রোগ্রাম, ডেটা এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করে | ইনপুট মডিউল | সেন্সর থেকে সংকেত গ্রহণ করে | আউটপুট মডিউল | আউটপুট ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করে | পাওয়ার সাপ্লাই | বিদ্যুৎ সরবরাহ করে | প্রোগ্রামিং ডিভাইস | পিএলসি প্রোগ্রাম করার জন্য ব্যবহৃত হয় |
পিএলসি-র প্রকারভেদ
বিভিন্ন প্রকার পিএলসি পাওয়া যায়, যা তাদের আকার, ক্ষমতা এবং প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে আলাদা করা হয়। কিছু প্রধান প্রকার নিচে উল্লেখ করা হলো:
- কম্প্যাক্ট পিএলসি: ছোট আকারের এবং সীমিত ইনপুট/আউটপুট (I/O) ক্ষমতা সম্পন্ন।
- মডুলার পিএলসি: এই ধরনের পিএলসি-তে প্রয়োজন অনুযায়ী মডিউল যোগ করা যায়, যা এটিকে আরও নমনীয় করে তোলে।
- র্যাক-ভিত্তিক পিএলসি: এটি বড় আকারের এবং জটিল অ্যাপ্লিকেশনের জন্য উপযুক্ত।
- মাইক্রো পিএলসি: খুব ছোট আকারের এবং বিশেষ কাজের জন্য ডিজাইন করা।
প্রোগ্রামিং ভাষা
পিএলসি প্রোগ্রামিং করার জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষা ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে কিছু জনপ্রিয় ভাষা হলো:
- ল্যাডার ডায়াগ্রাম (Ladder Diagram - LD): এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পিএলসি প্রোগ্রামিং ভাষা, যা রিলে লজিকের মতো দেখতে। ল্যাডার লজিক
- ফাংশন ব্লক ডায়াগ্রাম (Function Block Diagram - FBD): গ্রাফিক্যাল প্রোগ্রামিং ভাষা, যা ফাংশন ব্লক ব্যবহার করে প্রোগ্রাম তৈরি করে। ফাংশন ব্লক
- স্ট্রাকচার্ড টেক্সট (Structured Text - ST): উচ্চ-স্তরের প্রোগ্রামিং ভাষা, যা পাস্কেল (Pascal) এর মতো। স্ট্রাকচার্ড প্রোগ্রামিং
- ইনস্ট্রাকশন লিস্ট (Instruction List - IL): অ্যাসেম্বলি ভাষার মতো, এটি নিম্ন-স্তরের প্রোগ্রামিং ভাষা। অ্যাসেম্বলি ভাষা
- সিকোয়েন্সিয়াল ফাংশন চার্ট (Sequential Function Chart - SFC): জটিল প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে কার্যক্রম একটি নির্দিষ্ট ক্রম অনুসরণ করে।সিকোয়েন্স ডায়াগ্রাম
পিএলসি-র সুবিধা
পিএলসি ব্যবহারের অনেক সুবিধা রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
- নমনীয়তা: পিএলসি প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে সহজেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পরিবর্তন করা যায়।
- নির্ভরযোগ্যতা: পিএলসি কঠিন পরিবেশে কাজ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এবং এটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য।
- খরচ-সাশ্রয়ী: পিএলসি স্বয়ংক্রিয়তা বৃদ্ধি করে এবং ত্রুটি কমিয়ে উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করে।
- সহজ রক্ষণাবেক্ষণ: পিএলসি-র সমস্যা নির্ণয় এবং সমাধান করা সহজ।
- যোগাযোগ ক্ষমতা: পিএলসি অন্যান্য ডিভাইস এবং সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। যোগাযোগ প্রোটোকল
পিএলসি-র প্রয়োগক্ষেত্র
পিএলসি বিভিন্ন শিল্পখাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর কিছু প্রধান প্রয়োগক্ষেত্র নিচে উল্লেখ করা হলো:
- উৎপাদন শিল্প: স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন লাইন, রোবোটিক সিস্টেম এবং প্যাকেজিং মেশিন নিয়ন্ত্রণে। শিল্প রোবোটিক্স
- পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাস শিল্প: তেল এবং গ্যাস পরিশোধন, বিতরণ এবং সংরক্ষণে।
- পাওয়ার জেনারেশন: বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থায়।
- জল ও পয়ঃনিষ্কাশন: জলের পরিশোধন, সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায়।
- পরিবহন: ট্র্যাফিক সিগন্যাল, রেলওয়ে সিস্টেম এবং বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনায়।
- বিল্ডিং অটোমেশন: আলো, তাপমাত্রা, এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে। স্মার্ট বিল্ডিং
পিএলসি প্রোগ্রামিং-এর মৌলিক ধারণা
পিএলসি প্রোগ্রামিং শুরু করার আগে কিছু মৌলিক ধারণা সম্পর্কে জানা দরকার।
- ইনপুট (Input): সেন্সর বা সুইচ থেকে আসা সংকেত, যা পিএলসি গ্রহণ করে।
- আউটপুট (Output): পিএলসি থেকে পাঠানো সংকেত, যা মোটর বা ভালভের মতো ডিভাইসকে নিয়ন্ত্রণ করে।
- কন্ডিশন (Condition): একটি শর্ত, যা সত্য বা মিথ্যা হতে পারে এবং প্রোগ্রামের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
- টাইমার (Timer): একটি নির্দিষ্ট সময় পর কোনো কার্যক্রম শুরু বা বন্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। টাইমার ফাংশন
- কাউন্টার (Counter): কোনো ঘটনা কতবার ঘটেছে তা গণনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। কাউন্টার ফাংশন
পিএলসি এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য
পিএলসি ছাড়াও আরও অনেক ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন রিলে লজিক, কম্পিউটার কন্ট্রোল সিস্টেম, এবং ডিসট্রিবিউটেড কন্ট্রোল সিস্টেম (DCS)। নিচে পিএলসি এবং অন্যান্য ব্যবস্থার মধ্যে কিছু পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
- রিলে লজিক: এটি পুরনো দিনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা ইলেকট্রোমেকানিক্যাল রিলে ব্যবহার করে। পিএলসি রিলে লজিকের চেয়ে বেশি নমনীয়, নির্ভরযোগ্য এবং প্রোগ্রামযোগ্য।
- কম্পিউটার কন্ট্রোল সিস্টেম: এটি সাধারণ উদ্দেশ্যযুক্ত কম্পিউটার ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালায়। পিএলসি বিশেষভাবে শিল্পখাতের জন্য ডিজাইন করা, তাই এটি আরও নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুত।
- ডিসট্রিবিউটেড কন্ট্রোল সিস্টেম (DCS): এটি বড় আকারের এবং জটিল প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়। পিএলসি সাধারণত ছোট এবং মাঝারি আকারের অ্যাপ্লিকেশনের জন্য বেশি উপযুক্ত। ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম
পিএলসি-র ভবিষ্যৎ প্রবণতা
পিএলসি প্রযুক্তিতে ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে। ভবিষ্যতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা হলো:
- ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ (Industry 4.0): পিএলসিগুলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংস (IIoT) এবং স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং-এর সাথে একত্রিত হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০
- ক্লাউড-ভিত্তিক পিএলসি: পিএলসি ডেটা ক্লাউডে সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, যা রিমোট মনিটরিং এবং কন্ট্রোল সুবিধা প্রদান করে। ক্লাউড কম্পিউটিং
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং (ML): পিএলসি-তে এআই এবং এমএল অ্যালগরিদম ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া আরও উন্নত করা হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
- ওয়্যারলেস পিএলসি: ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ব্যবহার করে পিএলসি-র ইনস্টলেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ করা হচ্ছে। ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন
- সাইবার নিরাপত্তা: পিএলসি সিস্টেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উন্নত সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা
উপসংহার
প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার (পিএলসি) শিল্পখাতে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর নমনীয়তা, নির্ভরযোগ্যতা এবং খরচ-সাশ্রয়ী বৈশিষ্ট্য এটিকে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের জন্য উপযুক্ত করে তুলেছে। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে পিএলসি আরও বুদ্ধিমান এবং সংযুক্ত হয়ে উঠবে, যা শিল্পখাতে স্বয়ংক্রিয়তার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
| রিসোর্স টাইপ | লিঙ্ক | পিএলসি প্রোগ্রামিং টিউটোরিয়াল | [1](https://www.plcacademy.com/) | সিমেন্স পিএলসি ম্যানুয়াল | [2](https://support.industry.siemens.com/) | অ্যালেন-ব্র্যাডলি পিএলসি ডকুমেন্টেশন | [3](https://literature.rockwellautomation.com/) | প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার ডাউনলোড | [4](https://www.se.com/ww/en/work/products/product-launch/plc-software/) |
আরও দেখুন
- শিল্প অটোমেশন
- সেন্সর
- অ্যাকচুয়েটর
- হিউম্যান-মেশিন ইন্টারফেস
- SCADA
- ডাটা অধিগ্রহণ
- নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
- ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
- কম্পিউটার বিজ্ঞান
- রোবোটিক্স
- স্বয়ংক্রিয়তা
- লজিক গেট
- বুলিয়ান বীজগণিত
- ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স
- মাইক্রোকন্ট্রোলার
- এম্বেডেড সিস্টেম
- রিয়েল-টাইম অপারেটিং সিস্টেম
- শিল্প নেটওয়ার্ক
- প্রোটোকল
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
