পাঁচ বাহিনীর মডেল
মাইকেল পোর্টারের পাঁচ বাহিনীর মডেল
ভূমিকা মাইকেল পোর্টারের পাঁচ বাহিনীর মডেল একটি শক্তিশালী ব্যবসা বিশ্লেষণ কাঠামো। এই মডেল কোনো শিল্পখাতের (Industry) আকর্ষণীয়তা এবং একটি কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয়। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল-এর অধ্যাপক মাইকেল পোর্টার ১৯৮০ সালে এই মডেলটি প্রস্তাব করেন। এই মডেলের মূল উদ্দেশ্য হল কোনো ব্যবসার লাভজনকতা এবং দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য নির্ধারণ করা। পাঁচ বাহিনীর মডেল একটি কোম্পানিকে তার শিল্পখাতের সুযোগ এবং হুমকিগুলো বুঝতে সাহায্য করে, যা কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক।
পাঁচটি শক্তি পোর্টারের মডেল অনুযায়ী, পাঁচটি প্রধান শক্তি একটি শিল্পখাতের প্রতিযোগিতামূলক তীব্রতা এবং আকর্ষণীয়তা নির্ধারণ করে। এই শক্তিগুলো হলো:
১. নতুন প্রতিযোগীর হুমকি (Threat of New Entrants) ২. সরবরাহকারীদের দর কষাকষির ক্ষমতা (Bargaining Power of Suppliers) ৩. ক্রেতাদের দর কষাকষির ক্ষমতা (Bargaining Power of Buyers) ৪. বিকল্প পণ্যের হুমকি (Threat of Substitute Products or Services) ৫. বিদ্যমান প্রতিযোগীদের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা (Rivalry Among Existing Competitors)
এই প্রতিটি শক্তি ব্যবসার উপর কেমন প্রভাব ফেলে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. নতুন প্রতিযোগীর হুমকি নতুন প্রতিযোগীর প্রবেশের সম্ভাবনা একটি শিল্পখাতে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিতে পারে। যদি কোনো শিল্পখাতে নতুন করে প্রবেশ করা সহজ হয়, তাহলে বিদ্যমান কোম্পানিগুলোকে তাদের বাজার শেয়ার এবং লাভজনকতা রক্ষার জন্য আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে। নতুন প্রতিযোগীর হুমকি নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে:
- প্রবেশের বাধা (Barriers to Entry): এই বাধাগুলো নতুন কোম্পানিগুলোর জন্য শিল্পখাতে প্রবেশ করা কঠিন করে তোলে। যেমন - উচ্চ মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজন, সরকারের বিধি-নিষেধ, পেটেন্ট, ব্র্যান্ড পরিচিতি ইত্যাদি।
- সরবরাহকারীদের ক্ষমতা: শক্তিশালী সরবরাহকারীরা নতুন প্রতিযোগীদের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল সরবরাহ করে।
- ক্রেতাদের আনুগত্য: যদি ক্রেতারা বিদ্যমান ব্র্যান্ডের প্রতি অনুগত হয়, তাহলে নতুন প্রতিযোগীদের তাদের আকৃষ্ট করা কঠিন হবে।
- প্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশা: বিদ্যমান কোম্পানিগুলো নতুন প্রতিযোগীর প্রবেশের প্রতিক্রিয়া কিভাবে জানাবে, তার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে।
২. সরবরাহকারীদের দর কষাকষির ক্ষমতা সরবরাহকারীরা তাদের দাম বাড়িয়ে বা পণ্যের গুণমান কমিয়ে কোম্পানির লাভজনকতাকে প্রভাবিত করতে পারে। সরবরাহকারীদের ক্ষমতা নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে:
- সরবরাহকারীর সংখ্যা: যদি অল্প সংখ্যক সরবরাহকারী থাকে, তাহলে তাদের ক্ষমতা বেশি থাকবে।
- সরবরাহকারীর আকার: বড় আকারের সরবরাহকারীরা সাধারণত ছোট কোম্পানির উপর বেশি প্রভাব ফেলে।
- পরিবর্তন খরচ: যদি কোনো কোম্পানি সহজেই অন্য সরবরাহকারীর কাছে যেতে পারে, তাহলে সরবরাহকারীর ক্ষমতা কম হবে।
- সরবরাহকারীর পণ্যের স্বতন্ত্রতা: যদি সরবরাহকারীর পণ্য বিশেষায়িত হয় এবং এর কোনো বিকল্প না থাকে, তাহলে তাদের ক্ষমতা বেশি থাকবে।
- ফরওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন: সরবরাহকারীরা যদি নিজেরাই কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে, তাহলে তাদের ক্ষমতা বাড়বে।
৩. ক্রেতাদের দর কষাকষির ক্ষমতা ক্রেতারা দাম কমাতে, ভালো মানের পণ্য বা পরিষেবা দাবি করতে এবং প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারে। ক্রেতাদের ক্ষমতা নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে:
- ক্রেতার সংখ্যা: যদি অল্প সংখ্যক ক্রেতা থাকে, তাহলে তাদের ক্ষমতা বেশি থাকবে।
- ক্রেতার আকার: বড় ক্রেতারা সাধারণত ছোট কোম্পানির উপর বেশি প্রভাব ফেলে।
- পরিবর্তন খরচ: যদি ক্রেতারা সহজেই অন্য কোম্পানির কাছে যেতে পারে, তাহলে তাদের ক্ষমতা বাড়বে।
- পণ্যের স্বতন্ত্রতা: যদি পণ্যগুলো সাধারণ হয় এবং এর কোনো বিশেষত্ব না থাকে, তাহলে ক্রেতাদের ক্ষমতা বেশি থাকবে।
- ক্রেতাদের তথ্য: ক্রেতাদের কাছে যদি পণ্যের দাম এবং গুণমান সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে, তাহলে তারা দর কষাকষিতে শক্তিশালী হবে।
৪. বিকল্প পণ্যের হুমকি বিকল্প পণ্য বা পরিষেবাগুলো ক্রেতাদের জন্য বিভিন্ন বিকল্প সরবরাহ করে, যা কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে। বিকল্প পণ্যের হুমকি নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে:
- বিকল্প পণ্যের সহজলভ্যতা: যদি বাজারে অনেক বিকল্প পণ্য থাকে, তাহলে হুমকি বেশি।
- বিকল্প পণ্যের দাম: বিকল্প পণ্যের দাম কম হলে, ক্রেতারা সহজেই সেগুলোর দিকে ঝুঁকতে পারে।
- ক্রেতাদের পরিবর্তন খরচ: যদি ক্রেতারা সহজেই বিকল্প পণ্যে পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে হুমকি বাড়বে।
- বিকল্প পণ্যের গুণমান: বিকল্প পণ্যের গুণমান ভালো হলে, তা মূল পণ্যের চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে।
৫. বিদ্যমান প্রতিযোগীদের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান প্রতিযোগীদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা লাভজনকতা কমাতে পারে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন - মূল্য যুদ্ধ, বিজ্ঞাপন প্রতিযোগিতা, নতুন পণ্যের প্রবর্তন ইত্যাদি। প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে:
- প্রতিযোগীর সংখ্যা: যদি অনেক প্রতিযোগী থাকে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হবে।
- শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধির হার: যদি শিল্পখাত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, তাহলে প্রতিযোগীরা বাজার শেয়ারের জন্য আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
- পণ্যের পার্থক্য: যদি পণ্যগুলো একই রকম হয়, তাহলে মূল্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে।
- বের হওয়ার বাধা: যদি কোম্পানিগুলো সহজে শিল্পখাত থেকে বের হতে না পারে, তাহলে তারা আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
- কৌশলগত স্টেকহোল্ডিং: যদি কোনো কোম্পানি অন্য কোম্পানির উপর কৌশলগতভাবে নির্ভরশীল হয়, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম হতে পারে।
পোর্টারের মডেলের ব্যবহার পোর্টারের পাঁচ বাহিনীর মডেল ব্যবহার করে একটি কোম্পানি নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে পারে:
- শিল্পখাতের আকর্ষণীয়তা মূল্যায়ন করা।
- নিজের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বোঝা।
- কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা।
- ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলো মোকাবিলার উপায় বের করা।
- বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া।
উদাহরণ স্মার্টফোন শিল্পখাত:
- নতুন প্রতিযোগীর হুমকি: মাঝারি। কারণ, এই শিল্পখাতে প্রবেশ করতে প্রচুর বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি প্রয়োজন।
- সরবরাহকারীদের ক্ষমতা: মাঝারি। কারণ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ কয়েকটি সরবরাহকারীর হাতে রয়েছে।
- ক্রেতাদের ক্ষমতা: উচ্চ। কারণ, বাজারে অনেক বিকল্প ব্র্যান্ড রয়েছে এবং ক্রেতারা সহজেই একটি ব্র্যান্ড থেকে অন্য ব্র্যান্ডে যেতে পারে।
- বিকল্প পণ্যের হুমকি: কম। কারণ, স্মার্টফোনের বিকল্প পণ্য এখনো তেমন উন্নত নয়।
- বিদ্যমান প্রতিযোগীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা: খুব উচ্চ। কারণ, এই শিল্পখাতে অ্যাপল, স্যামসাং, শাওমি-এর মতো অনেক বড় কোম্পানি রয়েছে।
সীমাবদ্ধতা পোর্টারের পাঁচ বাহিনীর মডেল একটি শক্তিশালী কাঠামো হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:
- এটি একটি স্ট্যাটিক মডেল, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে।
- এটি শিল্পের সামগ্রিক চিত্র দেখায়, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বিবেচনা করে না।
- মডেলটি সরলীকৃত, তাই এটি শিল্পের জটিলতা সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত করতে পারে না।
- কিছু ক্ষেত্রে, এই মডেলের শক্তিগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে, যা বিশ্লেষণকে কঠিন করে তোলে।
অন্যান্য কৌশলগত সরঞ্জাম পোর্টারের পাঁচ বাহিনীর মডেলের পাশাপাশি আরও কিছু কৌশলগত সরঞ্জাম রয়েছে যা ব্যবসা বিশ্লেষণে ব্যবহার করা যেতে পারে:
- SWOT বিশ্লেষণ (Strengths, Weaknesses, Opportunities, Threats)
- PESTEL বিশ্লেষণ (Political, Economic, Social, Technological, Environmental, Legal)
- ভ্যালু চেইন বিশ্লেষণ
- BCG ম্যাট্রিক্স (Boston Consulting Group Matrix)
- আনসফ ম্যাট্রিক্স (Ansoff Matrix)
উপসংহার মাইকেল পোর্টারের পাঁচ বাহিনীর মডেল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ব্যবস্থাপনা সরঞ্জাম। এটি কোম্পানিগুলোকে তাদের শিল্পখাতের প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি বুঝতে এবং কার্যকর কৌশল তৈরি করতে সাহায্য করে। এই মডেল ব্যবহার করে, কোম্পানিগুলো তাদের লাভজনকতা বাড়াতে এবং দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য অর্জন করতে পারে। এই মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলি বিবেচনায় নিয়ে অন্যান্য কৌশলগত সরঞ্জামের সাথে এটি ব্যবহার করা উচিত।
আরও জানতে
- প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা
- শিল্পখাত বিশ্লেষণ
- কৌশলগত পরিকল্পনা
- বাজার গবেষণা
- বিপণন কৌশল
- ফিনান্সিয়াল মডেলিং
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- যোগান শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা
- মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা
- গুণমান নিয়ন্ত্রণ
- গ্রাহক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা
- ব্র্যান্ডিং
- বিজ্ঞাপন
- ডিজিটাল মার্কেটিং
- সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং
- কন্টেন্ট মার্কেটিং
- ইমেইল মার্কেটিং
- সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
