পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ (Green building) বলতে এমন একটি নির্মাণ প্রক্রিয়াকে বোঝায় যেখানে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব কমিয়ে আনা হয়। এর মধ্যে ডিজাইন, নির্মাণ, পরিচালনা এবং ভবনের জীবনচক্রের শেষ পর্যন্ত সবকিছু অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ শুধুমাত্র পরিবেশের সুরক্ষাই করে না, এটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যও সহায়ক।
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের গুরুত্ব
বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় সমস্যা। এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো নির্মাণ শিল্প। সিমেন্ট উৎপাদন, ভবন নির্মাণ এবং ব্যবহারের ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে পরিচিত। পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের মাধ্যমে এই গ্যাস নির্গমন কমানো সম্ভব। এছাড়াও, এর গুরুত্বগুলো হলো:
- পরিবেশের সুরক্ষা: প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কমিয়ে এবং দূষণ হ্রাস করে পরিবেশকে রক্ষা করে।
- বিদ্যুৎ সাশ্রয়: উন্নত ডিজাইন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ভবনের বিদ্যুৎ চাহিদা কমিয়ে আনা যায়।
- জলের সংরক্ষণ: বৃষ্টির জল সংরক্ষণ এবং জলের পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে জলের অপচয় রোধ করা যায়।
- স্বাস্থ্যকর পরিবেশ: ভবনের অভ্যন্তরে উন্নত বায়ুচলাচল এবং প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
- অর্থনৈতিক সুবিধা: দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ, জল এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমিয়ে অর্থ সাশ্রয় করা যায়।
- সামাজিক দায়বদ্ধতা: পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করা যায়।
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের মূল উপাদান
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণে বেশ কিছু মূল উপাদান রয়েছে, যা একটি ভবনকে পরিবেশ-বান্ধব করে তোলে। নিচে কয়েকটি প্রধান উপাদান আলোচনা করা হলো:
- স্থায়িত্ব (Sustainability): এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পদ সংরক্ষিত থাকে। টেকসই উন্নয়ন এই ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- শক্তি দক্ষতা (Energy Efficiency): কম শক্তি ব্যবহার করে একই কাজ করার ব্যবস্থা করা। যেমন - সৌর প্যানেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, উন্নতমানের ইন্সুলেশন ব্যবহার করে তাপ অপচয় কমানো ইত্যাদি। শক্তি সাশ্রয়ী বাতি ব্যবহার এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
- জলের দক্ষতা (Water Efficiency): জলের অপচয় রোধ করা এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা। জলের পুনর্ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
- উপকরণ (Materials): পরিবেশ বান্ধব এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা। যেমন - বাঁশ, কাঠ, পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক ইত্যাদি। পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়।
- স্থানের ব্যবহার (Site Planning): এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর কম প্রভাব পড়ে। বিদ্যমান গাছপালা রক্ষা করা এবং সবুজ স্থান তৈরি করা। ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
- indoor environmental quality (IEQ): ভবনের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করা। বায়ু দূষণ কমাতে হবে।
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ কৌশল
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নিচে উল্লেখ করা হলো:
- প্যাসিভ ডিজাইন (Passive Design): সূর্যের আলো, বাতাস এবং তাপমাত্রার সঠিক ব্যবহার করে ভবনের শক্তি চাহিদা কমানো।
- সবুজ ছাদ (Green Roof): ছাদের উপর গাছপালা লাগিয়ে তাপ কমানো এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা।
- ওয়াল গ্রিন (Wall Green): দেয়ালের উপর গাছপালা লাগিয়ে পরিবেশ ঠান্ডা রাখা।
- উন্নত ইন্সুলেশন (Improved Insulation): দেয়াল, ছাদ এবং মেঝেতে উন্নতমানের ইন্সুলেশন ব্যবহার করে তাপ অপচয় কমানো।
- ডাবল গ্লেজিং (Double Glazing): জানালাগুলিতে ডাবল গ্লেজিং ব্যবহার করে শব্দ দূষণ এবং তাপ অপচয় কমানো।
- স্মার্ট বিল্ডিং টেকনোলজি (Smart Building Technology): স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো, তাপমাত্রা এবং অন্যান্য সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
- বৃষ্টির জল সংগ্রহ (Rainwater Harvesting): বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা।
- solar energy (সৌর শক্তি): সৌর প্যানেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। সৌর প্যানেলের কার্যকারিতা বাড়ানো প্রয়োজন।
- wind energy (বায়ু শক্তি): বায়ু টারবাইন ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।
- geothermal energy (ভূ-তাপীয় শক্তি): ভূগর্ভের তাপ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।
| সামগ্রীর নাম | বৈশিষ্ট্য | ব্যবহার |
|---|---|---|
| বাঁশ | দ্রুত বর্ধনশীল, হালকা ও টেকসই | কাঠামো নির্মাণ, মেঝে, দেয়াল |
| কাঠ | পুনর্ব্যবহারযোগ্য, প্রাকৃতিক | কাঠামো নির্মাণ, দরজা, জানালা |
| পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক | টেকসই, পরিবেশ বান্ধব | মেঝে, দেয়াল, আসবাবপত্র |
| ফ্লাই অ্যাশ কংক্রিট | সিমেন্টের বিকল্প, পরিবেশ বান্ধব | কাঠামো নির্মাণ |
| মাটি | প্রাকৃতিক, সহজলভ্য | দেয়াল নির্মাণ, প্লাস্টার |
| শণ (Hemp) | টেকসই, পরিবেশ বান্ধব | ইন্সুলেশন, দেয়াল নির্মাণ |
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের চ্যালেঞ্জ
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ অনেক উপকারী হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- উচ্চ প্রাথমিক খরচ: পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সামগ্রী এবং প্রযুক্তি সাধারণত প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল।
- জ্ঞানের অভাব: অনেক স্থপতি, প্রকৌশলী এবং নির্মাণ কর্মীদের পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই।
- নীতিমালা ও বিধিবিধানের অভাব: পরিবেশ বান্ধব নির্মাণকে উৎসাহিত করার জন্য পর্যাপ্ত নীতিমালা এবং বিধিবিধানের অভাব রয়েছে।
- সরবরাহ শৃঙ্খল (Supply Chain): পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সামগ্রীর সরবরাহ শৃঙ্খল এখনও দুর্বল।
- জনসচেতনতার অভাব: সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সম্পর্কে সচেতনতা কম।
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের ভবিষ্যৎ
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন এবং পরিবেশ দূষণের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের চাহিদা বাড়ছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি এবং উপকরণ উদ্ভাবিত হবে যা পরিবেশ বান্ধব নির্মাণকে আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী করে তুলবে।
- 3D প্রিন্টিং: থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত এবং কম খরচে পরিবেশ বান্ধব ভবন নির্মাণ করা সম্ভব।
- ন্যানোটেকনোলজি: ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে উন্নতমানের নির্মাণ সামগ্রী তৈরি করা সম্ভব, যা পরিবেশ বান্ধব হবে।
- বায়ো-ভিত্তিক উপকরণ: বায়ো-ভিত্তিক উপকরণ যেমন শণ, বাঁশ এবং কাঠের ব্যবহার বাড়ানো হবে।
- স্মার্ট সিটি: স্মার্ট সিটিগুলোতে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে।
বাংলাদেশে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ
বাংলাদেশে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের ধারণা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা এবং ডেভেলপার কোম্পানি পরিবেশ বান্ধব ভবন নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছে। তবে, বাংলাদেশে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের প্রসার আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত সহায়তা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় পরিবেশ বান্ধব নির্মাণকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে।
উপসংহার
পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ শুধুমাত্র একটি নির্মাণ পদ্ধতি নয়, এটি একটি জীবনধারা। পরিবেশের সুরক্ষা, মানুষের স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ অপরিহার্য। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।
আরও দেখুন
- টেকসই উন্নয়ন
- জলবায়ু পরিবর্তন
- গ্রিনহাউস গ্যাস
- শক্তি সাশ্রয়
- পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী
- সৌর শক্তি
- বায়ু শক্তি
- ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা
- বায়ু দূষণ
- বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
- পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়
- শক্তি সাশ্রয়ী বাতি
- জলের পুনর্ব্যবহার
- সৌর প্যানেলের কার্যকারিতা
- ওয়াল গ্রিন
- সবুজ ছাদ
- স্মার্ট বিল্ডিং টেকনোলজি
- বৃষ্টির জল সংগ্রহ
- ভূ-তাপীয় শক্তি
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
