পরাবাস্তববাদ

পরাবাস্তববাদ (Surrealism) বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের একটি প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয় এবং শিল্প, সাহিত্য, দর্শন এবং রাজনৈতিক চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলে। পরাবাস্তববাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তিবাদী চিন্তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অবচেতন মন, স্বপ্ন এবং কল্পনার জগৎকে অন্বেষণ করা। এই নিবন্ধে, পরাবাস্তববাদের উৎপত্তি, বৈশিষ্ট্য, প্রধান শিল্পী ও সাহিত্যিক, এবং এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

উৎপত্তি ও প্রেক্ষাপট

পরাবাস্তববাদের শিকড় প্রোথিত রয়েছে দাদাবাদ (Dadaism) নামক একটি পূর্ববর্তী শিল্প আন্দোলনের মধ্যে। দাদাবাদীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুক্তিহীনতা ও ধ্বংসলীলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রচলিত শিল্পকলা ও সামাজিক রীতিনীতির প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ১৯২৪ সালে প্যারিসে আঁদ্রে Breton (André Breton) পরাবাস্তববাদকে একটি স্বতন্ত্র আন্দোলন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ব্র Breton-এর লেখা ‘পরাবাস্তববাদ বিষয়ক প্রথম ইশতেহার’ (Manifesto of Surrealism) এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি স্থাপন করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মানুষের মনে গভীর দাগ কাটে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক জগতে একটি সংকট সৃষ্টি করে। প্রচলিত মূল্যবোধ ও যুক্তিবাদী চিন্তার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে, পরাবাস্তববাদীরা সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud)-এর মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হন। ফ্রয়েডের অবচেতন মন, স্বপ্ন এবং কামুক ইচ্ছার ধারণার উপর ভিত্তি করে পরাবাস্তববাদীরা মানুষের মনের গভীরে লুকানো জগৎকে উন্মোচন করার চেষ্টা করেন।

পরাবাস্তববাদের বৈশিষ্ট্য

পরাবাস্তববাদের বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এটিকে অন্যান্য শিল্প আন্দোলন থেকে আলাদা করে তুলেছে:

অবচেতন মনের উপর জোর: পরাবাস্তববাদীরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষের অবচেতন মনে এমন অনেক শক্তি ও সম্ভাবনা নিহিত আছে যা যুক্তিবাদী মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। তারা স্বপ্ন, স্বয়ংক্রিয় লেখা (automatic writing) এবং অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করে অবচেতন মনকে প্রকাশ করার চেষ্টা করতেন।
অযৌক্তিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা: পরাবাস্তববাদী শিল্প ও সাহিত্যে অযৌক্তিকতা, অপ্রত্যাশিত সংযোগ এবং স্বতঃস্ফূর্ততাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। তারা যুক্তিবাদী বিন্যাস এবং কারণ-কার্য সম্পর্কের নিয়মকে অগ্রাহ্য করতেন।
স্বপ্নের জগৎ: স্বপ্ন পরাবাস্তববাদীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। তারা স্বপ্নের প্রতীকী ভাষা, অদ্ভুত দৃশ্য এবং অযৌক্তিক ঘটনাগুলোকে তাদের কাজে তুলে ধরতেন।
বিদ্রোহী চেতনা: পরাবাস্তববাদীরা প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ছিলেন। তারা সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ এবং নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করতেন।
নতুন প্রকাশভঙ্গি: পরাবাস্তববাদীরা শিল্পকলায় নতুন নতুন কৌশল ও পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যেমন কোলাজ (collage), ফ্রটেজ (frottage) এবং গ্রাত্তাজ (grattage)।

প্রধান শিল্পী ও সাহিত্যিক

পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে অনেক প্রভাবশালী শিল্পী ও সাহিত্যিক অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের উল্লেখযোগ্য কাজ নিচে উল্লেখ করা হলো:

সালভাদর দালি (Salvador Dalí): স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি পরাবাস্তববাদের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে পরিচিত। তার ছবিগুলোতে স্বপ্ন, অবচেতন মন এবং যৌনতার প্রতীকী চিত্রকল্প ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে "The Persistence of Memory"।
রেনে Magritte (René Magritte): বেলজিয়ান চিত্রশিল্পী রেনে Magritte তার ছবিতে বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং দর্শকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। "The Treachery of Images" তার বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ম্যাক্স Ernst (Max Ernst): জার্মান-আমেরিকান চিত্রশিল্পী ম্যাক্স Ernst কোলাজ, ফ্রটেজ এবং গ্রাত্তাজের মতো কৌশল ব্যবহার করে পরাবাস্তববাদী শিল্প সৃষ্টি করেছেন।
জোয়ান Miro (Joan Miró): স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী জোয়ান Miro-র কাজে জৈব আকৃতি, প্রতীকী চিহ্ন এবং উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার দেখা যায়।
আঁদ্রে Breton (André Breton): পরাবাস্তববাদের প্রতিষ্ঠাতা আঁদ্রে Breton ছিলেন একজন প্রভাবশালী কবি ও তাত্ত্বিক। তিনি "Nadja" নামক একটি বিখ্যাত উপন্যাস রচনা করেন।
পল Eluard (Paul Éluard): ফরাসি কবি পল Eluard পরাবাস্তববাদী কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তার কবিতায় প্রেম, স্বাধীনতা এবং বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে।
লুই Aragon (Louis Aragon): ফরাসি ঔপন্যাসিক ও কবি লুই Aragon পরাবাস্তববাদী সাহিত্য আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

পরাবাস্তববাদী শিল্পী ও তাদের বিখ্যাত কাজ
শিল্পী	বিখ্যাত কাজ	মাধ্যম
সালভাদর দালি	The Persistence of Memory	চিত্রকলা
রেনে Magritte	The Treachery of Images	চিত্রকলা
ম্যাক্স Ernst	Celebes	চিত্রকলা
জোয়ান Miro	Carnival of Harlequin	চিত্রকলা
আঁদ্রে Breton	Nadja	সাহিত্য

পরাবাস্তববাদের প্রভাব

পরাবাস্তববাদ শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র এবং সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এর কিছু উল্লেখযোগ্য প্রভাব নিচে উল্লেখ করা হলো:

শিল্পকলা: পরাবাস্তববাদ বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলার ধারাকে নতুন পথে চালিত করে। অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম (Abstract Expressionism) এবং পপ আর্ট (Pop Art)-এর মতো পরবর্তী শিল্প আন্দোলনের উপর এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
সাহিত্য: পরাবাস্তববাদ সাহিত্যকে নতুন ভাষা ও শৈলী দিয়ে সমৃদ্ধ করে। উইলিয়াম এস. Burroughs (William S. Burroughs) এবং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (Gabriel García Márquez)-এর মতো লেখকদের কাজে পরাবাস্তববাদের প্রভাব দেখা যায়।
চলচ্চিত্র: পরাবাস্তববাদ চলচ্চিত্রের জগতে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করে। লুইস বুনিউয়েল (Luis Buñuel) এবং ডেভিড Lynch (David Lynch)-এর মতো চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের ছবিতে পরাবাস্তববাদী উপাদান ব্যবহার করেছেন।
মনোবিজ্ঞান: পরাবাস্তববাদীরা সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং মানুষের অবচেতন মন সম্পর্কে নতুন ধারণা দেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব: পরাবাস্তববাদীরা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং বিপ্লব (Revolution)-এর পক্ষে ছিলেন।

পরাবাস্তববাদের কৌশল ও পদ্ধতি

পরাবাস্তববাদীরা তাদের কাজে বিভিন্ন ধরনের কৌশল ও পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কৌশল হলো:

স্বয়ংক্রিয়তা (Automatism): এই পদ্ধতিতে শিল্পীরা কোনো সচেতন চিন্তা বা পরিকল্পনা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করতেন। এর মাধ্যমে অবচেতন মনকে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হতো।
ফ্রটেজ (Frottage): এই পদ্ধতিতে কাগজের উপর কোনো টেক্সচারযুক্ত বস্তু রেখে পেন্সিল বা অন্য কোনো মাধ্যমে ঘষে ছবি তৈরি করা হতো।
কোলাজ (Collage): এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের বস্তু, যেমন কাগজ, কাপড়, ছবি ইত্যাদি ব্যবহার করে একটি নতুন শিল্পকর্ম তৈরি করা হতো।
গ্রাত্তাজ (Grattage): এই পদ্ধতিতে পেইন্টের উপর স্ক্র্যাপ করে বা ঘষে টেক্সচার তৈরি করা হতো।
ডিকালককম্যানিয়া (Decalcomania): এই পদ্ধতিতে দুটি পৃষ্ঠের মধ্যে পেইন্ট ঘষে একটি অপ্রত্যাশিত নকশা তৈরি করা হতো।
অবচেতন লেখা (Automatic Writing): এটি একটি পদ্ধতি যেখানে শিল্পী বা লেখক সচেতনভাবে চিন্তা না করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিখতে থাকেন, যা অবচেতন মন থেকে উদ্ভূত হয়।

পরাবাস্তববাদের সমালোচনা

পরাবাস্তববাদ বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে অযৌক্তিক ও অর্থহীন বলে মনে করেন, আবার কেউ কেউ এর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সমালোচকদের মতে, পরাবাস্তববাদীরা সমাজের বাস্তব সমস্যা থেকে দূরে থেকে শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতি ও কল্পনার জগতে ডুবে ছিলেন। তবে, পরাবাস্তববাদের উদ্ভাবনী শক্তি এবং সংস্কৃতির উপর এর প্রভাব অনস্বীকার্য।

আধুনিক বিশ্বে পরাবাস্তববাদ

পরাবাস্তববাদের মূল আন্দোলনটি ১৯৩০-এর দশকে দুর্বল হয়ে গেলেও এর প্রভাব আজও বিদ্যমান। আধুনিক শিল্পকলা, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে পরাবাস্তববাদী উপাদান দেখা যায়। ডিজিটাল আর্ট (Digital Art) এবং ভিডিও গেম (Video Game)-এর মতো নতুন মাধ্যমেও পরাবাস্তববাদী ধারণাগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। পরাবাস্তববাদ মানুষের মন ও সমাজের উপর গভীর প্রভাব ফেলে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে আজও সমাদৃত।

পরাবাস্তববাদ একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক আন্দোলন। এর ধারণা, বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাব সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত হতে হলে বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা ও আলোচনা প্রয়োজন। এই নিবন্ধটি পরাবাস্তববাদের একটি প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে।

আরও জানতে:

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ