নার্সিসিজম
নার্সিসিজম : একটি বিস্তারিত আলোচনা
ভূমিকা
নার্সিসিজম একটি জটিল মানসিক অবস্থা। এটি ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত মুগ্ধতা, অন্যের প্রতি সহানুভূতি অভাব এবং শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেও অল্প পরিমাণে দেখা যেতে পারে, কিন্তু যখন এগুলো চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তা মানসিক রোগ হিসেবে গণ্য হয়। এই নিবন্ধে, নার্সিসিজমের বিভিন্ন দিক, এর প্রকারভেদ, কারণ, লক্ষণ, প্রভাব এবং আধুনিক যুগে এর মোকাবিলার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এছাড়াও, বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ের সাথে এর সম্পর্কযুক্ত কিছু মনস্তাত্ত্বিক দিকও আলোচনা করা হবে, যেখানে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
নার্সিসিজমের সংজ্ঞা ও ইতিহাস
নার্সিসিজম শব্দটি গ্রিক পুরাণ থেকে এসেছে। গ্রিক পুরাণে নার্সিসাস নামের এক সুদর্শন যুবক নিজের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট ছিল যে, সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলের দিকে তাকিয়ে থাকত এবং নিজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে যেত। অবশেষে, সে জলে ঝাঁপ দিয়ে মারা যায়। এই থেকেই নার্সিসিজম শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ নিজের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ।
মনোবিজ্ঞানে, নার্সিসিজম প্রথম স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ফ্রয়েড মনে করতেন, নার্সিসিজম হলো মানুষের যৌন বিকাশের একটি প্রাথমিক পর্যায়, যেখানে শিশুরা নিজেদেরকে সবকিছু মনে করে। পরবর্তীতে, কার্ল জং এবং অন্যান্য মনোবিজ্ঞানী এই ধারণাকে আরও বিস্তৃত করেন। বর্তমানে, নার্সিসিজমকে একটি ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য এবং মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নার্সিসিজমের প্রকারভেদ
নার্সিসিজম প্রধানত দুই প্রকার:
১. গ্র্যান্ডিওজ নার্সিসিজম (Grandiose Narcissism): এই প্রকার নার্সিসিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদেরকে খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিভাবান এবং অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। তারা নিজেদের সাফল্যের কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে এবং অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে ক্ষমতার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে এবং তারা প্রায়শই অন্যদের শোষণ করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে।
২. ভালনারেবল নার্সিসিজম (Vulnerable Narcissism): এই প্রকার নার্সিসিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বাইরে থেকে নম্র ও শান্ত মনে হলেও, ভেতরে ভেতরে তারা খুব সংবেদনশীল এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তারা সামান্য সমালোচনাও সহ্য করতে পারে না এবং হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে এবং তারা প্রায়শই অন্যদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে।
এছাড়াও, আরও কিছু প্রকার নার্সিসিজম দেখা যায়, যেমন:
- ম্যালিগন্যান্ট নার্সিসিজম (Malignant Narcissism): এটি নার্সিসিজমের সবচেয়ে মারাত্মক রূপ, যেখানে অ্যান্টিসোশ্যাল বৈশিষ্ট্য, আগ্রাসন এবং অনুশোচনা বা অনুভূতির অভাব দেখা যায়।
- কভার্ট নার্সিসিজম (Covert Narcissism): এই ক্ষেত্রে ব্যক্তিরা সরাসরি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে না, বরং অন্যদের দুর্বলতা দেখিয়ে নিজেদের বড় করে তোলে।
নার্সিসিজমের কারণ
নার্সিসিজমের কারণ সম্পূর্ণরূপে জানা যায়নি, তবে মনে করা হয় যে এটি জিনগত, পরিবেশগত এবং মানসিক কারণগুলোর সংমিশ্রণের ফল।
- জিনগত কারণ: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে নার্সিসিজমের প্রবণতা বংশগত হতে পারে।
- পরিবেশগত কারণ: শৈশবের অভিজ্ঞতা, যেমন অতিরিক্ত প্রশংসা, অবহেলা বা নির্যাতন, নার্সিসিজমের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে।
- মানসিক কারণ: কিছু মানসিক রোগ, যেমন Borderline Personality Disorder, নার্সিসিজমের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।
নার্সিসিজমের লক্ষণ
নার্সিসিজমের লক্ষণগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণভাবে কিছু প্রধান লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- নিজের সম্পর্কে অত্যধিক মুগ্ধতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি।
- অন্যের প্রতি সহানুভূতি অভাব।
- অতিরিক্ত মনোযোগ এবং প্রশংসার আকাঙ্ক্ষা।
- নিজেকে বিশেষ এবং অনন্য মনে করা।
- অন্যদের শোষণ করার প্রবণতা।
- অহংকার এবং দাম্ভিকতা।
- সমালোচনা সহ্য করতে না পারা।
- আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা।
- সম্পর্কে সমস্যা এবং বন্ধুত্বের অভাব।
- অতিরিক্ত ঈর্ষা এবং সন্দেহপ্রবণতা।
বাইনারি অপশন ট্রেডিং এবং নার্সিসিজম
বাইনারি অপশন ট্রেডিং একটি উচ্চ-ঝুঁকির বিনিয়োগ ক্ষেত্র। এখানে, ট্রেডাররা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি সম্পদের দাম বাড়বে নাকি কমবে, তা অনুমান করে। এই ট্রেডিংয়ের সাথে নার্সিসিজমের কিছু সম্পর্ক রয়েছে। নার্সিসিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই নিজেদেরকে খুব বুদ্ধিমান এবং ভাগ্যবান মনে করে। এই কারণে, তারা বাইনারি অপশনে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে ট্রেড করে এবং অনেক বেশি ঝুঁকি নেয়।
- অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস: নার্সিসিস্টরা মনে করে যে তারা বাজারের গতিবিধি সঠিকভাবে অনুমান করতে পারবে, যা তাদের ভুল সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করে।
- ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা: তারা নিজেদেরকে অপরাজেয় মনে করে, তাই বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করে না।
- হতাশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা: যখন তারা ট্রেডে হেরে যায়, তখন তারা নিজেদের ভুল স্বীকার করতে পারে না এবং হতাশ হয়ে আরও বেশি ঝুঁকি নেয়।
- স্বার্থপরতা: তারা শুধুমাত্র নিজের লাভের কথা চিন্তা করে এবং অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয় না।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে নার্সিসিস্টদের দ্রুত ক্ষতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। সফল ট্রেডিংয়ের জন্য প্রয়োজন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ এর সঠিক জ্ঞান এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ।
নার্সিসিজমের প্রভাব
নার্সিসিজম ব্যক্তির জীবন এবং সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
- ব্যক্তিগত জীবন: নার্সিসিজমের কারণে ব্যক্তি হতাশায় ভুগতে পারে, সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দিতে পারে।
- পেশাগত জীবন: কর্মক্ষেত্রে, নার্সিসিস্টরা প্রায়শই সহকর্মীদের সাথেConflict এ লিপ্ত হয় এবং তাদের কর্মজীবনের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
- সামাজিক জীবন: নার্সিসিস্টদের বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী কম থাকে, কারণ তারা অন্যদের সাথে সহানুভূতিশীল সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না।
- মানসিক স্বাস্থ্য: নার্সিসিজম অন্যান্য মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, যেমন ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি এবং substance abuse।
নার্সিসিজমের চিকিৎসা
নার্সিসিজমের চিকিৎসায় সাধারণত সাইকোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- সাইকোডাইনামিক থেরাপি: এই থেরাপি শৈশবের অভিজ্ঞতা এবং অচেতন মানসিক প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে কাজ করে।
- কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT): এই থেরাপি নেতিবাচক চিন্তা এবং আচরণের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে।
- ডায়ালেক্টিক্যাল বিহেভিয়ারাল থেরাপি (DBT): এই থেরাপি আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করে।
- মানসিক ঔষধ: কিছু ক্ষেত্রে, antidepressants বা mood stabilizers ব্যবহার করা যেতে পারে।
নার্সিসিজম মোকাবিলা করার উপায়
যদি আপনি নার্সিসিজমের শিকার হন, তাহলে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন:
- নিজের সীমানা নির্ধারণ করুন: নার্সিসিস্টদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে নিজের ব্যক্তিগত এবং মানসিক সীমানা নির্ধারণ করুন।
- সমর্থন চান: বন্ধু, পরিবার বা থেরাপিস্টের কাছ থেকে মানসিক সমর্থন নিন।
- নিজেকে শিক্ষিত করুন: নার্সিসিজম সম্পর্কে আরও জানুন, যাতে আপনি পরিস্থিতি ভালোভাবে বুঝতে পারেন।
- নিজের যত্ন নিন: নিজের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দিন।
- বাস্তববাদী হোন: নার্সিসিস্টদের পরিবর্তন করা কঠিন, তাই তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত প্রত্যাশা করবেন না।
বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে নার্সিসিজম নিয়ন্ত্রণ করার উপায়
বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ে নার্সিসিজমের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো কমাতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে:
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করুন: ট্রেড করার আগে একটি সুস্পষ্ট ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং তা অনুসরণ করুন।
- ছোট বিনিয়োগ করুন: প্রথমে ছোট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করুন এবং ধীরে ধীরে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ান।
- আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন: ট্রেড করার সময় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন এবং যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিন।
- শিক্ষিত হন: বাইনারি অপশন ট্রেডিং সম্পর্কে ভালোভাবে জানুন এবং বিভিন্ন কৌশল শিখুন।
- একজন পরামর্শকের সাহায্য নিন: অভিজ্ঞ ট্রেডার বা আর্থিক উপদেষ্টার পরামর্শ নিন।
উপসংহার
নার্সিসিজম একটি জটিল মানসিক অবস্থা, যা ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো কমানো সম্ভব। বাইনারি অপশন ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে, নার্সিসিজমের কারণে সৃষ্ট অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক জ্ঞান, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ট্রেডাররা সফল হতে পারে এবং আর্থিক ক্ষতি এড়াতে পারে।
আরও জানতে:
- মানসিক স্বাস্থ্য
- ব্যক্তিত্বের রোগ
- ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান
- কগনিটিভ থেরাপি
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- বাইনারি অপশন ট্রেডিং কৌশল
- আবেগ নিয়ন্ত্রণ
- আর্থিক পরিকল্পনা
- বিনিয়োগের ঝুঁকি
- মানসিক চাপ
- সম্পর্ক
- যোগাযোগ দক্ষতা
- আত্মবিশ্বাস
- হতাশা
- অ্যাংজাইটি
- borderline personality disorder
- antidepressants
- mood stabilizers
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
