নাইট্রিক অ্যাসিড

পরিচিতি

নাইট্রিক অ্যাসিড (HNO₃) একটি অত্যন্ত ক্ষয়কারক এবং শক্তিশালী অ্যাসিড। এটি একটি বর্ণহীন তরল, যদিও পুরোনো বা দূষিত হলে এটি হলুদ বর্ণ ধারণ করতে পারে। নাইট্রিক অ্যাসিড একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক যৌগ যা সার, বিস্ফোরক, এবং বিভিন্ন শিল্প প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। এটি একটি শক্তিশালী জারক এবং অনেক ধাতুর সাথে বিক্রিয়া করতে সক্ষম।

ইতিহাস

নাইট্রিক অ্যাসিডের ইতিহাস বেশ পুরনো। ৮ম শতাব্দীতে আলকেমিবিদরা প্রথম এটি তৈরি করেন, যদিও তখন এর বিশুদ্ধ রূপ ছিল না। তারা সালফিউরিক অ্যাসিড এবং নাইট্রেট লবণ-এর মিশ্রণ ব্যবহার করে এটি তৈরি করতেন, যা "অ্যাকোয়া ফোর্টিস" নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে, ১৬শ শতাব্দীতে, লাইব্রোনিক এবং রুয়েলিয়াস নাইট্রিক অ্যাসিডের উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নত করেন। ১৮শ শতাব্দীতে, কার্ল উইলহেলম শেলে এবং জোসেফ প্রিস্টলি নাইট্রিক অ্যাসিডের বৈশিষ্ট্য এবং উৎপাদন নিয়ে আরও গবেষণা করেন। শিল্পক্ষেত্রে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় ১৯শ শতাব্দীতে, যখন হ্যাবার-বসch প্রক্রিয়া-এর মাধ্যমে অ্যামোনিয়া থেকে নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন করা সহজলভ্য হয়।

রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য

রাসায়নিক সূত্র: HNO₃
আণবিক ভর: ৬৩.০১ গ্রাম/মোল
ঘনত্ব: ১.৫১ গ্রাম/সেমি³ (১০০% অ্যাসিড)
গলনাঙ্ক: -৪৩° সেলসিয়াস
স্ফুটনাঙ্ক: ৮৩° সেলসিয়াস
অম্লতা (pKa): -১.৩

নাইট্রিক অ্যাসিড একটি প্রোটন দাতা এবং শক্তিশালী জারক হিসাবে কাজ করে। এটি তিনটি প্রধান ধরনের লবণ তৈরি করে: নাইট্রেট, নাইট্রাইট এবং নাইট্রোসো যৌগ। নাইট্রিক অ্যাসিডের জারক ক্ষমতা এটিকে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয়।

উৎপাদন প্রক্রিয়া

নাইট্রিক অ্যাসিড মূলত অ্যামোনিয়া (NH₃) থেকে উৎপাদিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়:

১. অ্যামোনিয়ার জারণ: অ্যামোনিয়াকে প্লাটিনাম বা রোডিয়াম প্রভাবকের উপস্থিতিতে অক্সিজেনের সাথে জারিত করে নাইট্রিক অক্সাইড (NO) তৈরি করা হয়।

   4NH₃ + 5O₂ → 4NO + 6H₂O

২. নাইট্রিক অক্সাইডের জারণ: নাইট্রিক অক্সাইডকে আরও অক্সিজেনের সাথে জারিত করে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO₂) তৈরি করা হয়।

   2NO + O₂ → 2NO₂

৩. নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের শোষণ: নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডকে পানিতে শোষণ করে নাইট্রিক অ্যাসিড তৈরি করা হয়।

   3NO₂ + H₂O → 2HNO₃ + NO

এই প্রক্রিয়াটি হ্যাবার-বসch প্রক্রিয়া নামে পরিচিত। এছাড়াও, পূর্বে আর্ক প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হতো, যেখানে বৈদ্যুতিক আর্ক ব্যবহার করে নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন থেকে নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করা হতো।

ব্যবহার

নাইট্রিক অ্যাসিডের বহুমাত্রিক ব্যবহার রয়েছে। নিচে কয়েকটি প্রধান ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:

সার উৎপাদন: নাইট্রিক অ্যাসিড অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ইউরিয়া এবং অন্যান্য নাইট্রোজেন-ভিত্তিক সার উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এটি কৃষিখাতে উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
বিস্ফোরক উৎপাদন: গ্লাইসারিনের সাথে মিশিয়ে নাইট্রোগ্লিসারিন এবং সেলুলোজের সাথে মিশিয়ে সেলুলোজ নাইট্রেট (গানপাউডার) তৈরি করা হয়, যা বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পলিমার শিল্প: নাইলন এবং অন্যান্য পলিমার উৎপাদনে নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহৃত হয়।
ধাতু পরিশোধন: সোনা, রূপা এবং প্ল্যাটিনাম-এর মতো মূল্যবান ধাতু পরিশোধন করতে নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়।
রাসায়নিক শিল্প: রঞ্জক, ঔষধ এবং অন্যান্য রাসায়নিক যৌগ উৎপাদনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
পরিষ্কারক দ্রব্য: কিছু পরিষ্কারক দ্রব্যে এটি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে ধাতব পৃষ্ঠ পরিষ্কার করার জন্য।
ইচিং (Etching): ইলেকট্রনিক্স শিল্পে, সার্কিট বোর্ড তৈরিতে এবং অন্যান্য সূক্ষ্ম কাজে এটি ব্যবহার করা হয়।
গবেষণা: বিভিন্ন রাসায়নিক গবেষণা এবং পরীক্ষাগারে এটি একটি প্রয়োজনীয় বিকারক।

ঝুঁকি ও নিরাপত্তা

নাইট্রিক অ্যাসিড একটি অত্যন্ত ক্ষয়কারক পদার্থ। এর সংস্পর্শে আসা ত্বক, চোখ ও শ্বাসযন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। এটি দাহ্য পদার্থগুলির সাথে বিস্ফোরক মিশ্রণ তৈরি করতে পারে।

ত্বকের সংস্পর্শ: ত্বকে লাগলে গুরুতর রাসায়নিক পোড়া হতে পারে।
চোখের সংস্পর্শ: চোখের সংস্পর্শে আসলে অন্ধত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
শ্বাসযন্ত্রের সংস্পর্শ: শ্বাস নিলে ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
সংগ্রহ ও সংরক্ষণ: নাইট্রিক অ্যাসিডকে ঠান্ডা, শুকনো এবং ভাল বায়ু চলাচল করে এমন স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। এটি অবশ্যই অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ থেকে দূরে রাখতে হবে, বিশেষ করে দাহ্য পদার্থ থেকে।
ব্যবহারের সতর্কতা: কাজ করার সময় নিরাপত্তা চশমা, গ্লাভস এবং অ্যাপ্রোন ব্যবহার করা উচিত। কোনো প্রকার দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

নাইট্রিক অ্যাসিডের প্রকারভেদ

নাইট্রিক অ্যাসিড বিভিন্ন ঘনত্বে পাওয়া যায়:

পাতলা নাইট্রিক অ্যাসিড: প্রায় ১০-৩০% ঘনত্ব। এটি সাধারণত পরিষ্কারক এবং পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত হয়।
ঘন নাইট্রিক অ্যাসিড: প্রায় ৬০-৭0% ঘনত্ব। এটি সার এবং বিস্ফোরক উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
ফিউমিং নাইট্রিক অ্যাসিড: ৯0% এর বেশি ঘনত্ব, যা লাল ধোঁয়া উৎপন্ন করে। এটি বিশেষ রাসায়নিক সংশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়।

নাইট্রিক অ্যাসিডের ঘনত্ব এবং ব্যবহার
বৈশিষ্ট্য \| ব্যবহার \|	পাতলা, বর্ণহীন \| পরিষ্কারক, পরীক্ষাগার \|	ঘন, সামান্য হলুদ \| সার উৎপাদন, বিস্ফোরক \|	ফিউমিং, লাল ধোঁয়া \| বিশেষ রাসায়নিক সংশ্লেষণ \|

পরিবেশগত প্রভাব

নাইট্রিক অ্যাসিড নিঃসরণ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এটি অ্যাসিড বৃষ্টির অন্যতম কারণ, যা মাটি ও জলের দূষণ ঘটায়। এছাড়াও, নাইট্রিক অ্যাসিড গ্রিনহাউস গ্যাস নাইট্রাস অক্সাইড (N₂O) উৎপাদনে অবদান রাখে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।

বিকল্প

কিছু ক্ষেত্রে, পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প ব্যবহার করে নাইট্রিক অ্যাসিডের ব্যবহার কমানো যায়। যেমন, জৈব সার ব্যবহার করে রাসায়নিক সারের চাহিদা কমানো এবং পরিবেশ-বান্ধব পরিষ্কারক দ্রব্য ব্যবহার করা।

উপসংহার

নাইট্রিক অ্যাসিড একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প রাসায়নিক যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তবে, এর ক্ষয়কারক বৈশিষ্ট্য এবং পরিবেশগত প্রভাবের কারণে এটি ব্যবহারের সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। নিরাপদ ব্যবহার এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

আরও দেখুন

কৌশল, টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ এবং ভলিউম বিশ্লেষণ

(যদিও নাইট্রিক অ্যাসিড রাসায়নিক বিষয়, তবুও এই বিষয়গুলির সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য কিছু প্রাসঙ্গিক লিঙ্ক দেওয়া হলো)

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ