তৃতীয় ক্রুসেড

তৃতীয় ক্রুসেড (১১৮৯-১১৯২) ছিল জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য ইউরোপীয় রাজা ও সামন্তপ্রভুদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এটি দ্বিতীয় ক্রুসেড ব্যর্থ হওয়ার পর সংগঠিত হয় এবং সালাদিন-এর জেরুজালেম দখল করার প্রতিক্রিয়ায় এটি শুরু হয়েছিল। এই ক্রুসেডটি ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে ইউরোপের প্রভাবশালী নেতারা যেমন রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট, ফ্রেডরিক বার্বারোসা এবং ফিলিপ অগাস্টাস অংশগ্রহণ করেছিলেন।

পটভূমি

১১০৯-১১২৯ সাল পর্যন্ত প্রথম ক্রুসেডের সাফল্যের পর খ্রিস্টানরা পবিত্র ভূমিতে বেশ কয়েকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এর মধ্যে জেরুজালেম রাজ্য ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১২ শতকের শেষদিকে ইসলামিক শক্তিগুলো ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করে। সালাদিন, যিনি আয়ুবীয় সাম্রাজ্য-এর প্রতিষ্ঠাতা, তিনি মিশর ও সিরিয়াকে একত্রিত করে খ্রিস্টানদের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়ান। ১১৮৭ সালে হাত্তিনের যুদ্ধে সালাদিন জেরুজালেম রাজ্যকে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। এই ঘটনা ইউরোপে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তৃতীয় ক্রুসেডের ডাক আসে।

ক্রুসেডের প্রস্তুতি ও অংশগ্রহণকারী শক্তি

জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য পোপ তৃতীয় গ্রেগরি ১১৮৮ সালে ক্রুসেডের ঘোষণা দেন। এই ক্রুসেডে তিনজন প্রভাবশালী নেতা অংশগ্রহণ করেন:

ফ্রেডরিক বার্বারোসা: জার্মানির হোলি রোমান সম্রাট ফ্রেডরিক বার্বারোসা বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ক্রুসেডে যোগ দেন। তবে তিনি কিলিকিয়াতে একটি নদীতে ডুবে মারা যান, যা ক্রুসেডের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল।
রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট: ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট ছিলেন তৃতীয় ক্রুসেডের সবচেয়ে বিখ্যাত নেতা। তিনি তার সাহস, সামরিক দক্ষতা এবং রণকৌশলের জন্য পরিচিত ছিলেন।
ফিলিপ অগাস্টাস: ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাসও ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু তিনি জেরুজালেম অবরোধের সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে ফিরে যান।

এছাড়াও, ইতালীয় নৌবহর ক্রুসেডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা সৈন্য ও সরবরাহ পরিবহনে সহায়তা করে।

ক্রুসেডের পর্যায়ক্রম

তৃতীয় ক্রুসেড কয়েকটি প্রধান পর্যায়ে বিভক্ত ছিল:

ফ্রেডরিক বার্বারোসার অভিযান: ফ্রেডরিক বার্বারোসা তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আনাটোলিয়ার দিকে অগ্রসর হন। তিনি আইকনিয়াম অবরোধ করেন এবং স্থানীয় সেলজুক তুর্কিদের পরাজিত করেন। কিন্তু কিলিকিয়াতে একটি নদীতে ডুবে তার মৃত্যু হয়, ফলে জার্মান সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
রিচার্ড ও ফিলিপের যাত্রা: রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট এবং ফিলিপ অগাস্টাস ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স থেকে আলাদাভাবে যাত্রা শুরু করেন। তারা সিসিলিতে মিলিত হন এবং সেখান থেকে সাইপ্রাসের দিকে অগ্রসর হন। সাইপ্রাসে রিচার্ড স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করে দ্বীপটি দখল করেন এবং সেখানে তার ঘাঁটি স্থাপন করেন।
আক্রা অবরোধ: রিচার্ড ও ফিলিপের সম্মিলিত বাহিনী আক্রা শহর অবরোধ করে। এই অবরোধ প্রায় দুই বছর ধরে চলেছিল এবং এটি ছিল ক্রুসেডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘটনা। অবশেষে, ১১৯১ সালে আক্রা খ্রিস্টানদের হাতে পতিত হয়।
জেরুজালেম অবরোধ ও শান্তি চুক্তি: আক্রা পতনের পর রিচার্ড জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হন। তিনি আসকালন দখল করেন এবং জেরুজালেমের কাছাকাছি পৌঁছে যান। তবে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সালাদিনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে রিচার্ড একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির শর্ত ছিল যে জেরুজালেম মুসলিমদের অধীনে থাকবে, কিন্তু খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা অবাধে শহরটি পরিদর্শন করতে পারবে।

পর্যায়ক্রম	তারিখ	অংশগ্রহণকারী	ফলাফল	ফ্রেডরিক বার্বারোসার অভিযান	১১৮৯-১১৮৯	ফ্রেডরিক বার্বারোসা	বার্বারোসার মৃত্যু ও জার্মান সেনাবাহিনীর ছত্রভঙ্গ	রিচার্ড ও ফিলিপের যাত্রা	১১৮৯-১১৮৯	রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট, ফিলিপ অগাস্টাস	সাইপ্রাস দখল	আক্রা অবরোধ	১১৮৯-১১৯১	রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট, ফিলিপ অগাস্টাস, সালাদিন	আক্রার পতন	জেরুজালেম অবরোধ ও শান্তি চুক্তি	১১৯১-১১৯২	রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট, সালাদিন	শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, জেরুজালেম মুসলিমদের অধীনে

সামরিক কৌশল ও প্রযুক্তি

তৃতীয় ক্রুসেডে ব্যবহৃত সামরিক কৌশল এবং প্রযুক্তিগুলো ছিল সেই সময়ের জন্য অত্যাধুনিক। উভয় পক্ষই ঘোড়সওয়ার সৈন্য, পদাতিক সৈন্য এবং বেষ্টিত কৌশল ব্যবহার করত। ক্রুসেডাররা দুর্গ এবং ক্যাসেল নির্মাণে দক্ষ ছিল, যা তাদের ঘাঁটি সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করত। সালাদিন তার তিরন্দাজ এবং ঘোড়াসওয়ার সৈন্যদের সমন্বিত ব্যবহারের জন্য পরিচিত ছিলেন।

এই ক্রুসেডে নৌযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ক্রুসেডারদের নৌবহর সৈন্য ও সরবরাহ পরিবহনের পাশাপাশি উপকূলীয় শহরগুলো অবরোধ করতে সহায়ক ছিল।

ক্রুসেডের ফলাফল ও প্রভাব

তৃতীয় ক্রুসেড জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হলেও এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল:

সালাদিনের ক্ষমতা বৃদ্ধি: এই ক্রুসেডের ফলে সালাদিনের ক্ষমতা আরও সুদৃঢ় হয় এবং তিনি মুসলিম বিশ্বে একজন নায়ক হিসেবে পরিচিত হন।
ক্রুসেডার রাজ্যগুলোর দুর্বলতা: ক্রুসেডার রাজ্যগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে মুসলিমদের অধীনে চলে যায়।
ইউরোপের অর্থনীতি ও সমাজে প্রভাব: ক্রুসেডে অংশগ্রহণের ফলে ইউরোপের অর্থনীতি ও সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। অনেক সামন্তপ্রভু তাদের সম্পদ হারিয়ে ফেলে এবং বাণিজ্যRouteগুলো নতুন করে স্থাপিত হয়।
সাংস্কৃতিক বিনিময়: ক্রুসেডের মাধ্যমে ইউরোপীয় এবং মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে কিছু বিনিময় ঘটে, যা উভয় সমাজের ওপর প্রভাব ফেলে।

তৃতীয় ক্রুসেড মধ্যযুগীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ধর্মীয় আবেগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং সামরিক সংঘাতের একটি জটিল মিশ্রণ ছিল।