টেলিভিশন সম্প্রচার

ভূমিকা

টেলিভিশন সম্প্রচার হলো বেতার তরঙ্গ বা তারের মাধ্যমে টেলিভিশন নামক যন্ত্রে ছবি ও শব্দ সংকেত প্রেরণ এবং গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এটি যোগাযোগ ও গণমাধ্যমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। টেলিভিশন শুধু বিনোদনের উৎস নয়, এটি শিক্ষা, সংবাদ, রাজনীতি এবং বিজ্ঞাপন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

ইতিহাস

টেলিভিশনের ধারণা ১৯ শতকের শেষ দিকে শুরু হয়েছিল। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এবং পাউল Nipkow এর মতো বিজ্ঞানীরা এর প্রাথমিক বিকাশে অবদান রাখেন। ১৯২৬ সালে জন লগি Baird প্রথম টেলিভিশন যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এরপর ১৯৩০-এর দশকে ফিলিপ টি. Farnsworth এবং ভ্লাদিমির Zworykin ইলেকট্রনিক টেলিভিশন তৈরি করেন, যা আধুনিক টেলিভিশনের ভিত্তি স্থাপন করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টেলিভিশন দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য উন্নত দেশে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ১৯৬৪ সালে যাত্রা শুরু করে।

সম্প্রচার প্রযুক্তি

টেলিভিশন সম্প্রচারে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

অ্যানালগ টেলিভিশন: এটি পুরনো প্রযুক্তি, যেখানে ছবি ও শব্দ সংকেত ক্রমাগত তরঙ্গের আকারে প্রেরণ করা হতো।
ডিজিটাল টেলিভিশন: এটি আধুনিক প্রযুক্তি, যেখানে ছবি ও শব্দ সংকেত ডিজিটাল কোডে প্রেরণ করা হয়। এর ফলে উন্নত মানের ছবি ও শব্দ পাওয়া যায়। ডিজিটাল টেলিভিশন সম্প্রচারে DVB-T, DVB-S, ATSC ইত্যাদি স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহৃত হয়।
স্যাটেলাইট টেলিভিশন: এই পদ্ধতিতে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। DTH (Direct-to-Home) প্রযুক্তি এর একটি উদাহরণ।
কেবল টেলিভিশন: এই পদ্ধতিতে তারের মাধ্যমে টেলিভিশন সংকেত গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো হয়।
আইপিটিভি: ইন্টারনেট প্রোটোকল টেলিভিশন হলো ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখার পদ্ধতি।


প্রযুক্তি	গুণাগুণ	অসুবিধা
অ্যানালগ টেলিভিশন	সহজলভ্য, কম খরচ	কম ছবি ও শব্দ মান, দুর্বল সংকেত
ডিজিটাল টেলিভিশন	উচ্চ ছবি ও শব্দ মান, একাধিক চ্যানেল	ডিজিটাল রিসিভার প্রয়োজন, বেশি ব্যান্ডউইথ
স্যাটেলাইট টেলিভিশন	বিস্তৃত কভারেজ, অসংখ্য চ্যানেল	উচ্চ স্থাপন খরচ, আবহাওয়ার প্রভাব
কেবল টেলিভিশন	স্থিতিশীল সংকেত, স্থানীয় চ্যানেল	তার সংযোগ প্রয়োজন, মাসিক ফি
আইপিটিভি	চাহিদা অনুযায়ী প্রোগ্রাম, ইন্টারেক্টিভ সুবিধা	দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন

সম্প্রচার মাধ্যম

টেলিভিশন সম্প্রচার বিভিন্ন মাধ্যমে সম্পন্ন হয়:

ভূ-ভিত্তিক সম্প্রচার: এই পদ্ধতিতে ভূ-কেন্দ্রিক টাওয়ার থেকে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে সম্প্রচার করা হয়।
স্যাটেলাইট সম্প্রচার: ভূ-স্থির কক্ষপথে (Geostationary orbit) থাকা স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এই সম্প্রচার করা হয়।
কেবল সম্প্রচার: কো-অ্যাক্সিয়াল কেবল তারের মাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়।
ফাইবার অপটিক সম্প্রচার: ফাইবার অপটিক কেবল ব্যবহার করে উচ্চমানের সম্প্রচার করা হয়।

টেলিভিশন প্রোগ্রাম

টেলিভিশন প্রোগ্রামের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, যা দর্শকদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

সংবাদ ও তথ্য অনুষ্ঠান: সংবাদ, টক শো, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি।
নাটক ও সিরিয়াল: টেলিভিশন নাটক, ধারাবাহিক নাটক ইত্যাদি।
বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান: চলচ্চিত্র, সংগীত, রিয়েলিটি শো ইত্যাদি।
খেলাধুলা: লাইভ খেলা, স্পোর্টস প্রোগ্রাম ইত্যাদি।
শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান: শিক্ষণীয় প্রোগ্রাম, বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
শিশুতোষ অনুষ্ঠান: কার্টুন, শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম ইত্যাদি।

সম্প্রচারের নিয়মকানুন

টেলিভিশন সম্প্রচার একটি অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত মাধ্যম। প্রতিটি দেশে টেলিভিশন সম্প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মকানুন রয়েছে। এই নিয়মকানুনগুলি সাধারণত তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় বা অনুরূপ সরকারি সংস্থা দ্বারা প্রণীত হয়। নিয়মকানুনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

লাইসেন্স: টেলিভিশন চ্যানেল পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করা আবশ্যক।
বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ: সম্প্রচারিত প্রোগ্রামের বিষয়বস্তু অবশ্যই দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।
বিজ্ঞাপন বিধি: বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয়।
নৈতিক মানদণ্ড: সম্প্রচারিত প্রোগ্রামগুলিতে নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখা জরুরি।

ডিজিটাল যুগে টেলিভিশন

ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে টেলিভিশন সম্প্রচারেও পরিবর্তন এসেছে। স্মার্ট টেলিভিশন, স্ট্রিমিং পরিষেবা (যেমন: Netflix, Amazon Prime Video) এবং ভিডিও অন ডিমান্ড (VOD) -এর মতো নতুন মাধ্যমগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর ফলে দর্শকরা এখন নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী প্রোগ্রাম দেখার সুযোগ পাচ্ছেন।

ভবিষ্যৎ প্রবণতা

টেলিভিশন সম্প্রচারের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে নিম্নলিখিত প্রবণতাগুলি দেখা যেতে পারে:

8K এবং আলট্রা এইচডি: আরও উন্নত মানের ছবি দেখার অভিজ্ঞতা।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR): টেলিভিশনে নতুন মাত্রা যোগ করা।
ব্যক্তিগতকৃত সম্প্রচার: দর্শকদের রুচি অনুযায়ী প্রোগ্রাম সরবরাহ করা।
5G প্রযুক্তি: দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে উন্নত মানের সম্প্রচার।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): প্রোগ্রাম নির্বাচন এবং দর্শকদের অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সহায়ক।