জেরেমি বেন্থাম
জেরেমি বেন্থাম : জীবন, দর্শন ও উপযোগবাদ
পরিচিতি
জেরেমি বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২) ছিলেন একজন ব্রিটিশ দার্শনিক, আইনবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং উপযোগবাদ নামক নৈতিক দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের প্রভাবশালী চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। বেন্থামের কাজের মূল ভিত্তি ছিল মানুষের সুখ-দুঃখের হিসাব এবং এর মাধ্যমে নৈতিক ও আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, যেকোনো কাজের নৈতিকতা নির্ধারিত হবে সেই কাজের মাধ্যমে কতজন মানুষ উপকৃত হবে এবং কতজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার ওপর ভিত্তি করে।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
জেরেমি বেন্থাম ১৭৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল আইন ব্যবসার সাথে যুক্ত। বেন্থামের বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী এবং তার বড় ভাইও একই পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। জেরেমি প্রথমে তার বাবার কাছে এবং পরে ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি কুইন্স কলেজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, যেখানে তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অক্সফোর্ডে থাকাকালীন তিনি প্রচলিত আইন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করতে শুরু করেন। তিনি মনে করতেন, বিদ্যমান আইনগুলি যুক্তিসঙ্গত নয় এবং জনগণের কল্যাণের জন্য যথেষ্ট নয়।
কর্মজীবন ও অবদান
অক্সফোর্ড থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করার পর বেন্থাম একজন আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু তিনি খুব দ্রুত বুঝতে পারেন যে আইন পেশা তার আগ্রহের সাথে মেলে না। তিনি সমাজ ও আইনের সংস্কারের দিকে বেশি মনোযোগ দেন। বেন্থাম প্রায় দুই বছর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য কাজ করেন, কিন্তু সেখানকার দুর্নীতি ও অবিচার দেখে তিনি হতাশ হন।
বেন্থাম তার জীবনের বেশিরভাগ সময় লেখালেখি ও গবেষণার কাজে ব্যয় করেন। তিনি অসংখ্য বই, প্রবন্ধ ও চিঠি লিখেছেন। তার প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- An Introduction to the Principles of Morals and Legislation (১৭৮৯): এটি বেন্থামের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ, যেখানে তিনি উপযোগবাদের মূল ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করেছেন।
- A Fragment on Government (১৭৮৯): এই গ্রন্থে তিনি সরকারের গঠন ও কার্যাবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন।
- Principles of Penal Law (১৮৩০): এখানে তিনি অপরাধ ও শাস্তির বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন।
বেন্থাম প্যানঅপটিকন নামক একটি কারাগার নকশা করেন, যা তার নজরদারি তত্ত্বের একটি উদাহরণ। এই নকশায়, একজন প্রহরী কারাগারের কেন্দ্রে বসে সকল বন্দীর ওপর নজর রাখতে পারতেন।
উপযোগবাদের মূল ধারণা
জেরেমি বেন্থামের উপযোগবাদের মূল ধারণা হলো "সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ"। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হলো সুখ লাভ এবং দুঃখ পরিহার করা। কোনো কাজের নৈতিকতা বিচার করার সময়, দেখতে হবে যে সেই কাজটি কত বেশি মানুষের জন্য সুখ নিয়ে আসে।
উপযোগবাদের দুটি প্রধান দিক রয়েছে:
- কর্ম উপযোগবাদ (Act Utilitarianism): এই মতবাদ অনুযায়ী, প্রতিটি কাজের ফলাফল বিবেচনা করে তার নৈতিকতা নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ, কোনো কাজ যদি তাৎক্ষণিকভাবে বেশি সুখ নিয়ে আসে, তবে সেটি নৈতিকভাবে সঠিক।
- বিধি উপযোগবাদ (Rule Utilitarianism): এই মতবাদ অনুযায়ী, কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করতে হবে, যা সাধারণভাবে বেশি সুখ নিয়ে আসে। এই নিয়মগুলি অনুসরণ করে কাজ করলে দীর্ঘমেয়াদে সমাজের কল্যাণ হবে।
বেন্থাম সুখকে একটি পরিমাপযোগ্য বিষয় হিসেবে দেখেছেন। তিনি "সুখ গণনা" (Hedonic Calculus) নামক একটি পদ্ধতির প্রস্তাব করেন, যার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার সুখের পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়। এই পদ্ধতিতে সুখের তীব্রতা, স্থায়িত্ব, নিশ্চিততা, নৈকট্য, প্রজননশীলতা এবং বিশুদ্ধতা - এই সাতটি বিষয় বিবেচনা করা হয়।
বেন্থামের রাজনৈতিক ও আইনগত দর্শন
জেরেমি বেন্থাম ছিলেন একজন উদারপন্থী এবং সংস্কারক। তিনি সরকারের ক্ষমতা সীমিত করার পক্ষে ছিলেন এবং জনগণের অধিকারের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি আইনের শাসনের গুরুত্বের কথা বলেছিলেন এবং আইনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বেন্থাম মনে করতেন, আইন তৈরি করার সময় সমাজের সকলের সুখ-দুঃখের কথা বিবেচনা করা উচিত। তিনি দরিদ্র ও দুর্বল মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি গণতন্ত্র, ভোটাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা-র মতো ধারণাগুলোর সমর্থন করেছিলেন।
বেন্থামের সমালোচনা
জেরেমি বেন্থামের উপযোগবাদ বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। কিছু সমালোচকের মতে, উপযোগবাদ সংখ্যালঘুদের অধিকারকে উপেক্ষা করে। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠের সুখের জন্য সংখ্যালঘুদের স্বার্থ বলি দেওয়া হতে পারে।
অন্যান্য সমালোচকরা বলেন, সুখকে পরিমাপ করা কঠিন এবং ব্যক্তিভেদে সুখের ধারণা ভিন্ন হতে পারে। তাছাড়া, উপযোগবাদ প্রায়শই তাৎক্ষণিক ফলাফলের ওপর বেশি জোর দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিবেচনা করে না।
জন স্টুয়ার্ট মিল, যিনি বেন্থামের একজন অনুসারী ছিলেন, পরবর্তীতে উপযোগবাদের কিছু দুর্বলতা সংশোধন করার চেষ্টা করেন। তিনি গুণগত দিক থেকে সুখের পার্থক্য করেন এবং মানসিক সুখকে শারীরিক সুখের চেয়ে বেশি মূল্যবান বলে মনে করেন।
বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এর সাথে সংযোগ
জেরেমি বেন্থামের উপযোগবাদের ধারণা বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এর ক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় সমান্তরালতা তৈরি করে। বাইনারি অপশন ট্রেডিং হলো একটি আর্থিক বিনিয়োগ যেখানে একজন ট্রেডার একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি সম্পদের দাম বাড়বে নাকি কমবে তা অনুমান করে।
- ঝুঁকি ও পুরস্কারের হিসাব: বাইনারি অপশনে, একজন ট্রেডারকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি তার অনুমান সঠিক হয়, তবে সে একটি পূর্বনির্ধারিত পরিমাণ অর্থ লাভ করে। অন্যথায়, তার বিনিয়োগ করা অর্থ সম্পূর্ণভাবে നഷ്ട হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে, ট্রেডারকে ঝুঁকি ও পুরস্কারের মধ্যে একটি হিসাব করতে হয়, যা বেন্থামের সুখ-দুঃখের হিসাবের অনুরূপ।
- সম্ভাব্য ফলাফলের মূল্যায়ন: একজন সফল বাইনারি অপশন ট্রেডারকে বিভিন্ন সম্ভাব্য ফলাফলের মূল্যায়ন করতে হয় এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রে, ট্রেডারকে দেখতে হয় যে কোন বিকল্পটি তার জন্য সর্বাধিক লাভজনক হতে পারে। এটি বেন্থামের উপযোগবাদের "সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ" ধারণাটির সাথে মেলে।
- নিয়ন্ত্রিত ঝুঁকি: উপযোগবাদের মূলনীতি অনুসরণ করে, একজন ট্রেডার তার ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অল্প পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে এবং স্টপ-লস অর্ডার ব্যবহার করে ট্রেডার তার সম্ভাব্য ক্ষতি সীমিত করতে পারে।
তবে, বাইনারি অপশন ট্রেডিং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এবং এতে বিনিয়োগ করার আগে ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত।
| বিষয় | ব্যাখ্যা | উপযোগবাদ | "সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ" - এই নীতির ওপর ভিত্তি করে নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। | সুখ গণনা | সুখের তীব্রতা, স্থায়িত্ব, নিশ্চিততা, নৈকট্য, প্রজননশীলতা এবং বিশুদ্ধতা - এই সাতটি বিষয় বিবেচনা করে সুখের পরিমাণ নির্ধারণ। | প্যানঅপটিকন | একটি কারাগার নকশা, যেখানে একজন প্রহরী কারাগারের কেন্দ্রে বসে সকল বন্দীর ওপর নজর রাখতে পারে। | আইন সংস্কার | আইনের শাসনের গুরুত্ব এবং আইনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান। | রাজনৈতিক উদারতাবাদ | সরকারের ক্ষমতা সীমিত করা এবং জনগণের অধিকারের ওপর জোর দেওয়া। |
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
জেরেমি বেন্থামের দর্শন আধুনিক রাজনৈতিক ও আইনগত চিন্তাধারার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার উপযোগবাদ তত্ত্ব নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
বেন্থামের কাজ জন স্টুয়ার্ট মিল, হেনরি সিজউইক এবং জি. ই. মুর-এর মতো প্রভাবশালী দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছে। তার ধারণাগুলো আধুনিক সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র এবং মানবাধিকারের ধারণার বিকাশে সহায়ক হয়েছে।
বর্তমানেও, বেন্থামের কাজ প্রাসঙ্গিক এবং বিভিন্ন নৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে তার উপযোগবাদী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
| ক্ষেত্র | প্রয়োগ | অর্থনীতি | সামাজিক কল্যাণমূলক নীতি নির্ধারণ এবং সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণ। | রাষ্ট্রবিজ্ঞান | সরকারি নীতি প্রণয়ন এবং জনগণের জন্য কল্যাণকর কর্মসূচি গ্রহণ। | আইন | অপরাধ ও শাস্তির বিধান এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। | স্বাস্থ্যসেবা | স্বাস্থ্যসেবার অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার। | পরিবেশ বিজ্ঞান | পরিবেশ সুরক্ষার নীতি নির্ধারণ এবং পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন। |
উপসংহার
জেরেমি বেন্থাম ছিলেন একজন দূরদর্শী দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার উপযোগবাদ তত্ত্ব মানুষের সুখ ও কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে নৈতিক ও আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি শক্তিশালী কাঠামো প্রদান করে। বেন্থামের কাজ আজও প্রাসঙ্গিক এবং সমাজকে উন্নত করার জন্য তার ধারণাগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
উপযোগবাদ নৈতিক দর্শন রাজনৈতিক দর্শন আইনের দর্শন জন স্টুয়ার্ট মিল প্যানঅপটিকন সুখ সুখ গণনা নজরদারি গণতন্ত্র ভোটাধিকার বাকস্বাধীনতা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ ভলিউম বিশ্লেষণ ফিনান্সিয়াল মার্কেট বিনিয়োগ ঝুঁকি পুরস্কার স্টপ-লস অর্ডার হেজিং ডাইভার্সিফিকেশন মার্কেট সেন্টিমেন্ট ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ বাইনারি অপশন ট্রেডিং স্ট্র্যাটেজি
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
