জীবাণু
জ্বীনাতুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধে জীবাণুর ভূমিকা
ভূমিকা
জীবাণু বলতে সাধারণত সেই সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবন্ত সত্তাকে বোঝায়, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস এবং পরজীবী উল্লেখযোগ্য। জীবাণু আমাদের চারপাশের পরিবেশের সর্বত্র বিদ্যমান এবং মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগের ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু জীবাণু আমাদের জন্য উপকারী, আবার কিছু জীবাণু রোগের কারণ হতে পারে। এই নিবন্ধে জীবাণুর প্রকৃতি, প্রকারভেদ, মানুষের জীবনে এদের প্রভাব এবং রোগ প্রতিরোধে এদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
জীবাণুর ইতিহাস
জীবাণু আবিষ্কারের পূর্বে রোগ কিভাবে ছড়ায় সে সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল খুবই সীমিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েনহুক নামক একজন বিজ্ঞানী প্রথম মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে জীবাণু পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত জীবাণু রোগের কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়নি। উনিশ শতকে লুই পাস্তর এবং রবার্ট কখ-এর যুগান্তকারী গবেষণা জীবাণু তত্ত্বের জন্ম দেয়। পাস্তর প্রমাণ করেন যে ফার্মেন্টেশন এবং পচন জীবাণুর কারণে ঘটে। কখ কখের সূত্র (Koch's postulates) প্রণয়ন করেন, যা কোনো জীবাণুকে রোগের কারণ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে। এই আবিষ্কারগুলি চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং জনস্বাস্থ্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
জীবাণুর প্রকারভেদ
জীবাণুকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়:
১. ব্যাকটেরিয়া: এরা এককোষী প্রোক্যারিওটিক জীব। এদের নিজস্ব কোষীয় অঙ্গাণু রয়েছে এবং এরা বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। কিছু ব্যাকটেরিয়া উপকারী, যেমন - দই তৈরিতে ব্যবহৃত ব্যাকটেরিয়া। আবার কিছু ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিকর, যেমন - কলেরা, টাইফয়েড এবং নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া।
২. ভাইরাস: এরা অকোষী এবং সম্পূর্ণরূপে পরজীবী। ভাইরাসের নিজস্ব প্রজনন ক্ষমতা নেই। এরা জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি করে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইডস, কোভিড-১৯ ইত্যাদি ভাইরাসজনিত রোগ।
৩. ফাঙ্গাস: এরা ইউক্যারিওটিক জীব এবং এদের মধ্যে একককোষী (যেমন - ইস্ট) এবং বহুকোষী (যেমন - ছত্রাক) উভয় প্রকার দেখা যায়। ফাঙ্গাস ত্বকের সংক্রমণ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং খাদ্যনালীর সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
৪. পরজীবী: এরা অন্য জীবের উপর বাস করে এবং তাদের ক্ষতি করে। পরজীবী প্রোটোজোয়া, হেলমিন্থ (কৃমি) ইত্যাদি হতে পারে। ম্যালেরিয়া, অ্যামিবিয়াসিস ইত্যাদি পরজীবীজনিত রোগ।
জীবাণুর গঠন
ব্যাকটেরিয়ার গঠন: ব্যাকটেরিয়ার প্রধান অংশগুলো হলো কোষ প্রাচীর, কোষ ঝিল্লি, সাইটোপ্লাজম, রাইবোসোম এবং নিউক্লিওয়েড। কিছু ব্যাকটেরিয়ার ফ্ল্যাজেলা (flagella) এবং পাইলি (pili) নামক অঙ্গাণু থাকে যা তাদের চলনে এবং পরিবেশে লেগে থাকতে সাহায্য করে।
ভাইরাসের গঠন: ভাইরাসের মূল উপাদান হলো নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA বা RNA), যা একটি প্রোটিন শেলের (capsid) মধ্যে আবদ্ধ থাকে। কিছু ভাইরাসের বাইরের দিকে অতিরিক্ত একটি আবরণ (envelope) থাকে।
ফাঙ্গাসের গঠন: ফাঙ্গাসের কোষ প্রাচীর কাইটিন (chitin) নামক পদার্থ দিয়ে গঠিত। এদের সাইটোপ্লাজমে বিভিন্ন কোষীয় অঙ্গাণু যেমন - নিউক্লিয়াস, মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোসোম ইত্যাদি বিদ্যমান।
পরজীবীর গঠন: পরজীবীর গঠন তাদের প্রজাতি এবং জীবনযাত্রার উপর নির্ভর করে। এদের জটিল জীবনচক্র দেখা যায় এবং এরা বিভিন্ন পোষকের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
জীবাণুর বিস্তার
জীবাণু বিভিন্ন উপায়ে বিস্তার লাভ করে, যেমন:
- বায়ু: হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময় নির্গত জলীয় কণা ও ধূলিকণার মাধ্যমে জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- পানি: দূষিত পানি পান করার মাধ্যমে বা দূষিত পানিতে গোসল করার মাধ্যমে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
- খাদ্য: দূষিত খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে জীবাণু পেটে প্রবেশ করতে পারে।
- সংস্পর্শ: সংক্রমিত ব্যক্তি বা বস্তুর সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে জীবাণু ছড়াতে পারে।
- ভেক্টর: মশা, মাছি, উকুন, ইত্যাদি ভেক্টরের মাধ্যমে জীবাণু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
রোগ প্রতিরোধে জীবাণুর ভূমিকা
আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধের জন্য দুটি প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে:
১. সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা (Innate Immunity): এটি জন্মগতভাবে প্রাপ্ত এবং এটি শরীরের প্রথম সারির প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে ত্বক, শ্লেষ্মা ঝিল্লি, ফ্যাগোসাইট (phagocyte) এবং প্রাকৃতিক ঘাতক কোষ (natural killer cells) উল্লেখযোগ্য।
২. অর্জিত প্রতিরোধ ক্ষমতা (Acquired Immunity): এটি জীবনকালে অর্জিত হয় এবং এটি নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। এর মধ্যে বি কোষ (B cells) এবং টি কোষ (T cells) প্রধান ভূমিকা পালন করে।
টিকা (Vaccine) এবং রোগ প্রতিরোধ
টিকা হলো দুর্বল বা মৃত জীবাণু অথবা তাদের অংশ দিয়ে তৈরি, যা শরীরে প্রবেশ করানো হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ভবিষ্যতে ঐ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে শরীর নিজেকে রক্ষা করতে পারে। পোলিও, মেকিন্স, রুবেলা, হেপাটাইটিস ইত্যাদি রোগের জন্য টিকা রয়েছে।
জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয়
- ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি: নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা।
- পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা: চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং দূষিত পদার্থ অপসারণ করা।
- নিরাপদ পানি ও খাদ্য: বিশুদ্ধ পানি পান করা এবং ভালোভাবে রান্না করা খাবার গ্রহণ করা।
- সামাজিক দূরত্ব: সংক্রমিত ব্যক্তিদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা।
- মাস্ক ব্যবহার: জনসমাগমস্থলে মাস্ক ব্যবহার করা।
- টিকা গ্রহণ: সময় মতো টিকা গ্রহণ করা।
টেবিল: সাধারণ জীবাণু এবং তাদের সৃষ্ট রোগ
| জীবাণু | রোগ | বিস্তার মাধ্যম |
| *Escherichia coli* | ডায়রিয়া, পেটের সংক্রমণ | দূষিত খাদ্য ও পানি |
| *Salmonella typhi* | টাইফয়েড | দূষিত খাদ্য ও পানি |
| *Vibrio cholerae* | কলেরা | দূষিত পানি |
| *Mycobacterium tuberculosis* | যক্ষ্মা (Tuberculosis) | বায়ু |
| *Influenza virus* | ইনফ্লুয়েঞ্জা | বায়ু |
| *Human Immunodeficiency Virus (HIV)* | এইডস (AIDS) | রক্ত, যৌন সংক্রামণ |
| *Plasmodium falciparum* | ম্যালেরিয়া | মশা |
| *Candida albicans* | ছত্রাক সংক্রমণ | ত্বক, মুখ, খাদ্যনালী |
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
জীবাণু বিজ্ঞান (Microbiology) একটি দ্রুত বিকাশমান ক্ষেত্র। নতুন নতুন জীবাণু আবিষ্কার হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ ও টিকা তৈরির জন্য গবেষণা চলছে। জিনোম সম্পাদনা (genome editing) এবং ইমিউনোথেরাপি (immunotherapy) -এর মতো আধুনিক প্রযুক্তিগুলি রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। ভবিষ্যতে জীবাণু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য আরও উন্নত কৌশল উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে।
গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্কসমূহ:
- ব্যাকটেরিয়া
- ভাইরাস
- ফাঙ্গাস
- পরজীবী
- মাইক্রোস্কোপ
- লুই পাস্তর
- রবার্ট কখ
- কখের সূত্র
- চিকিৎসা বিজ্ঞান
- জনস্বাস্থ্য
- প্রোক্যারিওটিক
- ইউক্যারিওটিক
- দই
- ইনফ্লুয়েঞ্জা
- এইডস
- কোভিড-১৯
- ফার্মেন্টেশন
- পচন
- টিকা
- জিনোম সম্পাদনা
- ইমিউনোথেরাপি
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
