জারণ বিজারণ
জারণ বিজারণ
ভূমিকা
জারণ-বিজারণ রসায়নের একটি মৌলিক ধারণা। এটি মূলত ইলেকট্রন স্থানান্তরের মাধ্যমে ঘটে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক রাসায়নিক প্রজাতি অন্য রাসায়নিক প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়। জারণ এবং বিজারণ উভয় প্রক্রিয়া একই সাথে ঘটে, এদেরকে একত্রে Redox বিক্রিয়া বলা হয়। এই বিক্রিয়াগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং বিভিন্ন শিল্প প্রক্রিয়াতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জারণ (Oxidation)
জারণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো পরমাণু, আয়ন বা অণু ইলেকট্রন ত্যাগ করে। ইলেকট্রন ত্যাগ করার ফলে জারণ সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। জারণ প্রক্রিয়ায় অক্সিডাইজিং এজেন্ট ইলেকট্রন গ্রহণ করে।
- ইলেকট্রন ত্যাগ: জারণের মূল বৈশিষ্ট্য হলো ইলেকট্রন হারানো।
- জারণ সংখ্যা বৃদ্ধি: ইলেকট্রন ত্যাগ করার কারণে জারণ সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
- অক্সিডাইজিং এজেন্ট: এই প্রক্রিয়ায় অন্য একটি পদার্থ ইলেকট্রন গ্রহণ করে, যা অক্সিডাইজিং এজেন্ট নামে পরিচিত।
উদাহরণস্বরূপ, লোহা যখন মরিচা ধরে, তখন সেটি জারিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় লোহা ইলেকট্রন ত্যাগ করে এবং অক্সিজেন ইলেকট্রন গ্রহণ করে।
Fe → Fe²⁺ + 2e⁻ (লোহা জারিত হচ্ছে)
বিজারণ (Reduction)
বিজারণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো পরমাণু, আয়ন বা অণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে। ইলেকট্রন গ্রহণ করার ফলে বিজারণ সংখ্যা হ্রাস পায়। বিজারণ প্রক্রিয়ায় রিডিউসিং এজেন্ট ইলেকট্রন সরবরাহ করে।
- ইলেকট্রন গ্রহণ: বিজারণের মূল বৈশিষ্ট্য হলো ইলেকট্রন গ্রহণ করা।
- বিজারণ সংখ্যা হ্রাস: ইলেকট্রন গ্রহণ করার কারণে বিজারণ সংখ্যা হ্রাস পায়।
- রিডিউসিং এজেন্ট: এই প্রক্রিয়ায় অন্য একটি পদার্থ ইলেকট্রন সরবরাহ করে, যা রিডিউসিং এজেন্ট নামে পরিচিত।
উদাহরণস্বরূপ, কপার অক্সাইডকে হাইড্রোজেন দ্বারা বিজারিত করলে কপার ধাতু উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়ায় কপার অক্সাইড ইলেকট্রন গ্রহণ করে এবং হাইড্রোজেন ইলেকট্রন সরবরাহ করে।
CuO + H₂ → Cu + H₂O (কপার অক্সাইড বিজারিত হচ্ছে)
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া (Redox Reaction)
জারণ এবং বিজারণ একই সাথে ঘটে। একটি পদার্থ জারিত হলে অন্যটি বিজারণ লাভ করে। এই যুগপৎ প্রক্রিয়াকে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া বলা হয়।
Redox বিক্রিয়ার উদাহরণ:
Zn(s) + Cu²⁺(aq) → Zn²⁺(aq) + Cu(s)
এখানে, জিঙ্ক জারিত হচ্ছে (ইলেকট্রন ত্যাগ করছে) এবং কপার আয়ন বিজারিত হচ্ছে (ইলেকট্রন গ্রহণ করছে)।
জারণ সংখ্যা (Oxidation State)
জারণ সংখ্যা হলো কোনো পরমাণুর উপর চার্জের পরিমাণ, যদি সেই যৌগটি সম্পূর্ণরূপে আয়নিক হয়। জারণ সংখ্যা নির্ধারণ করে কোনো পরমাণু জারিত হয়েছে নাকি বিজারিত হয়েছে তা বোঝা যায়।
জারণ সংখ্যা নির্ণয়ের নিয়ম:
- উপাদানের জারণ সংখ্যা সাধারণত শূন্য হয়।
- অক্সিজেনের জারণ সংখ্যা প্রায়শই -২ হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি +২ হতে পারে (যেমন, পারক্সাইড)।
- হাইড্রোজেনের জারণ সংখ্যা সাধারণত +১ হয়, তবে ধাতব হাইড্রাইডগুলিতে এটি -১ হতে পারে।
- যৌগের মোট চার্জের সমষ্টি শূন্য হতে হবে।
রেডক্স বিক্রিয়ার প্রকারভেদ
বিভিন্ন ধরনের রেডক্স বিক্রিয়া দেখা যায়, তাদের মধ্যে কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো:
- সংযোজন বিক্রিয়া: যখন কোনো পদার্থ অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়।
- অপসারণ বিক্রিয়া: যখন কোনো পদার্থ থেকে হাইড্রোজেন অপসারণ করা হয়।
- ডিসপ্রোপর্শনেশন বিক্রিয়া: একই মৌলের জারণ সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হ্রাস উভয়ই ঘটে।
- কমপ্লেক্স গঠন বিক্রিয়া: যখন কোনো আয়ন বা অণু জটিল যৌগ গঠন করে।
দৈনন্দিন জীবনে জারণ-বিজারণ
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে জড়িত। এর কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
- শ্বাস-প্রশ্বাস: আমাদের ফুসফুসে অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করা একটি রেডক্স প্রক্রিয়া।
- খাদ্য পরিপাক: খাদ্য পরিপাকের সময় জটিল অণুগুলি ভেঙে সরল অণুতে পরিণত হয়, যা রেডক্স বিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে।
- ধাতু নিষ্কাশন: ধাতু নিষ্কাশনের সময় আকরিক থেকে ধাতুগুলিকে জারিত করে আলাদা করা হয়।
- ব্যাটারি: ব্যাটারিতে রাসায়নিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করার জন্য রেডক্স বিক্রিয়া ব্যবহৃত হয়।
- ফটোগ্রাফি: ফটোগ্রাফিক ফিল্মে আলোক সংবেদনশীল রাসায়নিক পদার্থের রেডক্স বিক্রিয়ার মাধ্যমে ছবি তৈরি হয়।
শিল্পক্ষেত্রে জারণ-বিজারণ
শিল্পক্ষেত্রে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার প্রয়োগ ব্যাপক। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:
- ধাতুবিদ্যা: ধাতু নিষ্কাশন এবং পরিশোধন প্রক্রিয়ায় রেডক্স বিক্রিয়া ব্যবহৃত হয়।
- রাসায়নিক শিল্প: বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনে রেডক্স বিক্রিয়া অপরিহার্য।
- শক্তি উৎপাদন: ফুয়েল সেল এবং ব্যাটারিতে রেডক্স বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
- পরিবেশ বিজ্ঞান: দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সুরক্ষায় রেডক্স বিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রেডক্স টাইট্রেশন (Redox Titration)
রেডক্স টাইট্রেশন হলো একটি বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি, যা রেডক্স বিক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো দ্রব্যের ঘনত্ব নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে, একটি জারিত দ্রবণকে একটি বিজারক দ্রবণ দিয়ে টাইট্রেশন করা হয় অথবা এর বিপরীত।
- নিয়মিত দ্রবণ: রেডক্স টাইট্রেশনে ব্যবহৃত দ্রবণগুলি অবশ্যই নিয়মিত (standardized) হতে হবে।
- সূচক: বিক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার বিন্দু চিহ্নিত করার জন্য সূচক ব্যবহার করা হয়।
- সমতুল্য বিন্দু: যে বিন্দুতে জারিত এবং বিজারক দ্রবণের পরিমাণ সম্পূর্ণরূপে বিক্রিয়া করে, তাকে সমতুল্য বিন্দু বলে।
ইলেকট্রোকেমিস্ট্রি (Electrochemistry)
ইলেকট্রোকেমিস্ট্রি হলো রসায়নের সেই শাখা যা বিদ্যুৎ এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। রেডক্স বিক্রিয়া ইলেকট্রোকেমিস্ট্রির মূল ভিত্তি।
- ইলেকট্রোকেমিক্যাল সেল: এই সেলগুলি রাসায়নিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে বা বিদ্যুৎ শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
- ইলেক্ট্রোড: ইলেকট্রোকেমিক্যাল সেলে দুটি পরিবাহী প্রয়োজন, যাদেরকে ইলেকট্রোড বলে।
- ইলেক্ট্রোলাইট: এটি এমন একটি দ্রবণ যা আয়ন পরিবহন করতে পারে।
জারণ-বিজারণ এবং পরিবেশ
জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া পরিবেশের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
- মৃত্তিকা দূষণ: কিছু রেডক্স বিক্রিয়া মাটিতে দূষণ সৃষ্টি করতে পারে।
- জল দূষণ: শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থে রেডক্স বিক্রিয়া জলের গুণমান হ্রাস করতে পারে।
- বায়ু দূষণ: বায়ুমণ্ডলে রেডক্স বিক্রিয়া অ্যাসিড বৃষ্টি এবং অন্যান্য দূষণ সৃষ্টি করতে পারে।
- ওজোন স্তর: ওজোন স্তরের ক্ষয় এবং পুনরুদ্ধারে রেডক্স বিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রেডক্স বিক্রিয়ার কৌশল (Redox Reaction Mechanism)
রেডক্স বিক্রিয়ার কৌশলগুলি জটিল হতে পারে এবং প্রায়শই একাধিক ধাপের মাধ্যমে ঘটে। এই ধাপগুলি ইলেকট্রন স্থানান্তরের ক্রম এবং মধ্যবর্তী যৌগগুলির গঠন অন্তর্ভুক্ত করে।
- ধাপসমূহ: রেডক্স বিক্রিয়া সাধারণত একাধিক ধাপে সম্পন্ন হয়, যেখানে ইলেকট্রনগুলি এক পরমাণু থেকে অন্য পরমাণুতে স্থানান্তরিত হয়।
- মধ্যবর্তী যৌগ: বিক্রিয়ার সময় কিছু অস্থায়ী যৌগ তৈরি হতে পারে, যা মধ্যবর্তী যৌগ নামে পরিচিত।
- হার নির্ধারণী ধাপ: বিক্রিয়ার গতি определя করে এমন ধাপটিকে হার নির্ধারণী ধাপ বলা হয়।
ভোল্টেজ এবং রেডক্স বিভব (Voltage and Redox Potential)
রেডক্স বিভব (Redox Potential) হলো একটি পরিমাপ যা কোনো রাসায়নিক প্রজাতির ইলেকট্রন গ্রহণ বা ত্যাগ করার প্রবণতা নির্দেশ করে।
- স্ট্যান্ডার্ড রেডক্স বিভব: এটি একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা এবং চাপে রেডক্স বিক্রিয়ার ইলেকট্রন স্থানান্তরের প্রবণতা নির্দেশ করে।
- নেন্স্ট সমীকরণ: এই সমীকরণটি রেডক্স বিভবকে তাপমাত্রা, আয়নিক ঘনত্ব এবং অন্যান্য কারণের সাথে সম্পর্কিত করে।
- ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল সিরিজ: এটি বিভিন্ন রেডক্স বিক্রিয়ার স্ট্যান্ডার্ড রেডক্স বিভবের একটি তালিকা, যা জারক এবং বিজারকের শক্তি তুলনা করতে ব্যবহৃত হয়।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
জারণ-বিজারণ রসায়নের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। নতুন নতুন গবেষণা এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে এই ক্ষেত্রের আরও অনেক সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে।
- নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তি: উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি তৈরির জন্য রেডক্স রসায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
- পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি: দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নতুন রেডক্স ভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা সম্ভব।
- শক্তি উৎপাদন: সৌর শক্তি এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রেডক্স বিক্রিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে।
- নবায়নযোগ্য জ্বালানি: রেডক্স বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানি উৎপাদন করা যেতে পারে।
আরও জানতে
- রাসায়নিক বিক্রিয়া
- আয়নিক যৌগ
- রাসায়নিক বন্ধন
- তাপগতিবিদ্যা
- রাসায়নিক সাম্যাবস্থা
- অ্যাসিড-বেস রসায়ন
- জৈব রসায়ন
- অজৈব রসায়ন
- ভৌত রসায়ন
- বিশ্লেষণমূলক রসায়ন
- পলিমার রসায়ন
- পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা
- কোয়ান্টাম রসায়ন
- রাসায়নিক প্রকৌশল
- জৈবপ্রযুক্তি
- ন্যানোটেকনোলজি
- সবুজ রসায়ন
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- ফিনান্সিয়াল মডেলিং
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
