জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা

ভূমিকা

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (Food and Agriculture Organization of the United Nations), সংক্ষেপে এফএও (FAO) হলো জাতিসংঘ-এর একটি বিশেষায়িত সংস্থা। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা খাদ্য নিরাপত্তা এবং উন্নত পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে। এর সদর দপ্তর ইতালির রোম শহরে অবস্থিত। এফএও আন্তর্জাতিক খাদ্য, কৃষি, বন এবং মৎস্য সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে নেতৃত্ব প্রদান করে। বিশ্বের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি – এই তিনটি প্রধান ক্ষেত্র এফএও-র কর্মপরিধির অন্তর্ভুক্ত।

প্রতিষ্ঠা ও পটভূমি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে খাদ্য সংকট এবং কৃষি খাতের দুর্বলতাগুলো বিবেচনা করে ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর এফএও প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে খাদ্য সরবরাহ করা এবং কৃষি উৎপাদন পুনর্গঠনে সহায়তা করা। ১৯৪৫-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এফএও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংস্থা হিসেবে কাজ করে, যার সদর দপ্তর ওয়াশিংটন ডিসি-তে ছিল। ১৯৪৮ সালে এর সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর এটি স্থায়ী সংস্থায় রূপান্তরিত হয় এবং সদর দপ্তর রোমে স্থানান্তরিত করা হয়। লেইস্টার বি. পিয়ারসন ছিলেন প্রথম পরিচালক-সাধারণ।

এফএও-র কার্যাবলী

এফএও বিভিন্ন প্রকার কার্যক্রমের মাধ্যমে খাদ্য ও কৃষি খাতে অবদান রাখে। এর প্রধান কার্যাবলীগুলো হলো:

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এফএও-র অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি: কৃষিকাজের আধুনিকীকরণ, উন্নত বীজ ও সার ব্যবহার, এবং জলসেচের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
মৎস্য ও বন সম্পদ ব্যবস্থাপনা: মৎস্য চাষ এবং বন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা।
গ্রামীণ উন্নয়ন: গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ক গবেষণা: খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ এবং পুষ্টির মানোন্নয়নের জন্য গবেষণা পরিচালনা করা।
নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন: খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষির উন্নয়নে সহায়ক নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করা।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: খাদ্য ও কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং তথ্য আদান-প্রদান করা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দেওয়া এবং জরুরি সহায়তা প্রদান করা।

সাংগঠনিক কাঠামো

এফএও-র সাংগঠনিক কাঠামো বেশ বিস্তৃত। এর প্রধান অংশগুলো হলো:

সাধারণ পরিষদ (General Conference): এফএও-র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা, যেখানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এটি সাধারণত দুই বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়।
কাউন্সিল (Council): সাধারণ পরিষদের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, যা প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করে।
পরিচালক-সাধারণ (Director-General): এফএও-র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, যিনি সংস্থার দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বর্তমানে কু ডংইউ এই পদে আছেন।
বিভিন্ন বিভাগ (Departments): এফএও-র কার্যক্রম বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত, যেমন - কৃষি বিভাগ, মৎস্য ও জলজ চাষ বিভাগ, বন বিভাগ, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বিভাগ, ইত্যাদি।
আঞ্চলিক অফিস (Regional Offices): বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এফএও-র আঞ্চলিক অফিস রয়েছে, যা স্থানীয় সমস্যা সমাধানে কাজ করে।

এফএও-র সদস্য রাষ্ট্রসমূহ (২০২৩)
সদস্য সংখ্যা	১৯৫
আঞ্চলিক বিভাজন	আফ্রিকা: ৫৪ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর: ৩৬ ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া: ৫৬ ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান: ৩৩

এফএও-র গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ও উদ্যোগ

এফএও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

টেকসই কৃষি উন্নয়ন (Sustainable Agricultural Development): পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব কমিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কৃষি বাস্তুবিদ্যা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য সংকট প্রতিরোধ (Food Crisis Prevention): খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দেওয়া এবং জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা (Climate Change Adaptation): কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা। কার্বন নিঃসরণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বীজ ব্যাংক (Seed Banks): বিভিন্ন প্রকার শস্যের বীজ সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ডিজিটাল কৃষি (Digital Agriculture): তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিকাজের আধুনিকীকরণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।
খাদ্য অপচয় হ্রাস (Food Loss and Waste Reduction): খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত স্তরে খাদ্য অপচয় কমানোর জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
এক স্বাস্থ্য (One Health): মানুষ, পশু এবং পরিবেশের মধ্যে আন্তঃসংযোগ বিবেচনা করে স্বাস্থ্যখাতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।

খাদ্য নিরাপত্তা এবং এফএও

খাদ্য নিরাপত্তা একটি জটিল বিষয়, যা খাদ্য প্রাপ্যতা, খাদ্য ব্যবহারের সুযোগ, খাদ্যের স্থিতিশীলতা এবং খাদ্যের গুণগত মান – এই চারটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এফএও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে রয়েছে:

খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি: উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো এবং কৃষকদের সহায়তা করা।
খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা উন্নত করা: খাদ্য যেন সকলের কাছে সহজে পৌঁছায়, তার জন্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: দরিদ্র ও vulnerable জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চালু করা।
খাদ্য সংকট মোকাবিলা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে খাদ্য সংকট দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
পুষ্টির মান উন্নয়ন: খাদ্যপণ্যের পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করা এবং পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো।

খাদ্য অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং এফএও এই অধিকার রক্ষায় কাজ করে।

এফএও এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)

এফএও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে, SDG 2 (ক্ষুধা মুক্তি), SDG 12 (দায়িত্বপূর্ণ ভোগ ও উৎপাদন), SDG 13 (জলবায়ু কার্যক্রম), SDG 14 (জলজ জীবন) এবং SDG 15 (স্থলজ জীবন) – এই লক্ষ্যগুলো অর্জনে এফএও বিশেষভাবে কাজ করে।

এফএও-র কার্যক্রম টেকসই কৃষির উপর জোর দেয়, যা পরিবেশের ক্ষতি না করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে। সংস্থাটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য কৃষকদের সহায়তা করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করে।

সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ

এফএও বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো:

তহবিলের অভাব: এফএও-র কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব প্রায়শই দেখা যায়।
রাজনৈতিক জটিলতা: বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক মতপার্থক্য এফএও-র কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা এফএও-র জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি: দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি খাদ্য চাহিদার উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
খাদ্য অপচয়: বিপুল পরিমাণ খাদ্য অপচয় হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।
স্থানীয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত: বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের কারণে খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণ ব্যাহত হয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

এফএও ভবিষ্যতের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:

ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি: কৃষিকাজে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
জলবায়ু-সহনশীল কৃষি: জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন শস্যের জাত উদ্ভাবন এবং চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলন করা।
খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর: খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ এবং ভোগের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা, যাতে তা আরও টেকসই হয়।
উদ্ভাবনী অর্থায়ন: খাদ্য ও কৃষি খাতে বিনিয়োগের জন্য নতুন উৎস খুঁজে বের করা।
অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি: অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

উপসংহার

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষির উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি – এই লক্ষ্যগুলো অর্জনে এফএও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে, সংস্থাটিকে বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এফএও একটি ক্ষুধামুক্ত ও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়তে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।

আরও দেখুন

এই নিবন্ধে বাইনারি অপশন ট্রেডিং সম্পর্কিত কোনো তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, কারণ প্রশ্নকর্তা বিশেষভাবে সেই বিষয়ে নিবন্ধ লিখতে বলেননি। বরং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রদানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

এখনই ট্রেডিং শুরু করুন

IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)

আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন

আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ