গম চাষের পদ্ধতি
গম চাষের পদ্ধতি
ভূমিকা
গম (Triticum aestivum) বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য। এটি পুষ্টি এবং খাদ্য নিরাপত্তার একটি প্রধান উৎস। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ এবং এখানে গম একটি গুরুত্বপূর্ণ রবি শস্য। এই নিবন্ধে গম চাষের পদ্ধতি, উন্নত জাত, চাষের সময়, জমি তৈরি, বীজ বপন, সার প্রয়োগ, রোগ ও পোকা ব্যবস্থাপনা, ফসল সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
গমের উন্নত জাত
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের গমের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে, যা বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য উপযোগী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- বারী গম-২৩: এই জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধী।
- বারী গম-২৫: এটি মাঝারি উচ্চতার এবং বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে ভালোভাবে জন্মাতে পারে।
- গম-২৯: এই জাতটি লবণাক্ততা সহনশীল এবং উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত।
- অন্যান্য জাত: এছাড়াও স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী আরও অনেক জাত রয়েছে, যেমন - শতাব্দী, আকবর, এবং আশী। বীজ প্রজনন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে।
চাষের সময়
গম সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে চাষ করা হয়। তবে, এটি নির্ভর করে স্থানীয় জলবায়ু এবং মাটির ধরনের উপর। সাধারণত, ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা গম চাষের জন্য অনুকূল।
| পর্যায় | সময়কাল | কাজ |
| জমি তৈরি | অক্টোবর-নভেম্বর | জমি গভীরভাবে চাষ করা এবং আগাছা পরিষ্কার করা। |
| বীজ বপন | নভেম্বর-ডিসেম্বর | সঠিক সময়ে বীজ বপন করা। |
| সার প্রয়োগ | বপনের সময় ও চারা গজানোর পর | প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করা। |
| সেচ | প্রয়োজন অনুযায়ী | জমিতে প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করা। |
| রোগ ও পোকা দমন | নিয়মিত পর্যবেক্ষণ | রোগ ও পোকা শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। |
| ফসল সংগ্রহ | এপ্রিল-মে | গম পেকে গেলে ফসল সংগ্রহ করা। |
জমি তৈরি
গম চাষের জন্য জমি তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। নিচে জমি তৈরির পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
১. জমি বাছাই: গম চাষের জন্য দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। বেলে বা এঁটেল মাটিও ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে হবে। ২. জমি চাষ: গ্রীষ্মকালে জমি ভালোভাবে চাষ করে মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে। এরপর, বর্ষাকালে জমি পতিত রাখতে হয়। ৩. আগাছা পরিষ্করণ: জমি থেকে আগাছা সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করতে হবে। আগাছা থাকার কারণে গমের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। ৪. জমি সমতলকরণ: জমিতে যেন জল না জমে, সেজন্য জমি ভালোভাবে সমতল করতে হবে।
বীজ বপন
গম বপনের পূর্বে বীজ শোধন করা আবশ্যক। বীজ শোধনের জন্য থিরাম বা কার্বেন্ডাজিম নামক ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। বীজ বপনের নিয়মাবলী নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. বপনের পদ্ধতি: গম সাধারণত বীজ বপনের মাধ্যমে চাষ করা হয়। এটি সারিতে বা ছিটিয়ে বপন করা যেতে পারে। সারি করে বপন করলে ফলন ভালো হয়। ২. বীজের পরিমাণ: প্রতি হেক্টরে প্রায় ১২০-১৫০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। ৩. বপনের গভীরতা: বীজ বপনের গভীরতা ৩-৫ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত। ৪. সারি থেকে সারির দূরত্ব: সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার রাখা যেতে পারে।
সার প্রয়োগ
গম চাষের জন্য সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করা জরুরি। সার প্রয়োগের নিয়মাবলী নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. ভিত্তি সার: জমি তৈরির সময় প্রতি হেক্টরে ১০-১৫ টন জৈব সার (যেমন গোবর সার) প্রয়োগ করতে হবে। ২. ইউরিয়া: চারা গজানোর পর ইউরিয়া সার দুই দফায় প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম দফায় প্রতি হেক্টরে ৬০ কেজি এবং দ্বিতীয় দফায় ৪০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। ৩. টিএসপি: জমি তৈরির সময় প্রতি হেক্টরে ৫০-৬০ কেজি টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। ৪. এমওপি: জমি তৈরির সময় প্রতি হেক্টরে ২০-২৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। ৫. দস্তা সার: দস্তা deficient জমিতে প্রতি হেক্টরে ৫ কেজি দস্তা সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে সারের পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত।
সেচ ব্যবস্থাপনা
গম চাষের জন্য সময়মতো সেচ দেওয়া প্রয়োজন। গমের বিভিন্ন পর্যায়ে সেচের চাহিদা ভিন্ন হয়।
১. প্রথম সেচ: বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর প্রথম সেচ দিতে হবে। ২. দ্বিতীয় সেচ: চারা অবস্থা থেকে květন পর্যায়ে দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে। ৩. তৃতীয় সেচ: দানা গঠনের সময় তৃতীয় সেচ দিতে হবে। ৪. সেচের সতর্কতা: অতিরিক্ত সেচ পরিহার করতে হবে, কারণ অতিরিক্ত জল জমে গমের ক্ষতি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেচ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসতে পারে।
রোগ ও পোকা ব্যবস্থাপনা
গম চাষে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকার আক্রমণ হতে পারে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- রোগ:
* গম মরিচা: এটি একটি সাধারণ রোগ, যা পাতার উপর লালচে দাগ সৃষ্টি করে। * পাতার ব্লাইট: এই রোগে পাতায় কালো দাগ দেখা যায়। * গোড়া পচা: এই রোগে গাছের গোড়া পচে যায়।
- পোকা:
* জাবপোকা: এরা পাতার রস চুষে খায়। * মাজরা পোকা: এরা গাছের কাণ্ড ছিদ্র করে ক্ষতি করে। * শুঁয়োপোকা: এরা পাতা ও দানা খায়।
রোগ ও পোকা দমনের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করা। ২. বীজ শোধন করা। ৩. নিয়মিত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করা। ৪. আক্রান্ত গাছ অপসারণ করা। ৫. জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা। পরিবেশবান্ধব কৃষি practices অনুসরণ করা উচিত।
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
গম পেকে গেলে ফসল সংগ্রহ করতে হয়। ফসল সংগ্রহের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনে রাখতে হবে:
১. ফসল সংগ্রহের সময়: গম সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে সংগ্রহ করা হয়। যখন গমের দানা সম্পূর্ণরূপে শক্ত হয়ে যায় এবং পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়, তখন ফসল সংগ্রহ করা উচিত। ২. ফসল কাটার পদ্ধতি: কাস্তে বা ফসল কাটার যন্ত্রের সাহায্যে গম কাটা হয়। ৩. ফসল মাড়াই: কাটার পর গম মাড়াই করে দানা আলাদা করা হয়। ৪. ফসল সংরক্ষণ: গম ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। সংরক্ষণের জন্য শুকনো ও ঠান্ডা জায়গা নির্বাচন করতে হবে। গমে আর্দ্রতা থাকলে ছত্রাক লাগতে পারে। শস্য সংরক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
উন্নত চাষ পদ্ধতি
- সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management): রোগ ও পোকা দমনে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব পদ্ধতি ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার উপর জোর দিতে হবে।
- আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার: আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি যেমন - লেজার ল্যান্ড লেভেলিং, ড্রোন ব্যবহার করে ফসলের পর্যবেক্ষণ, এবং স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
- শস্য পর্যায় (Crop Rotation): একই জমিতে বারবার গম চাষ না করে অন্যান্য শস্যের সাথে শস্য পর্যায় অনুসরণ করা উচিত। এটি মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে সহায়ক।
- জৈব সার ব্যবহার: রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং পরিবেশ দূষণ কম হয়।
- জল সাশ্রয়ী প্রযুক্তি: ড্রিপ ইরিগেশন (Drip irrigation) ও স্প্রিংকলার সেচ (Sprinkler irrigation) ব্যবহারের মাধ্যমে জলের অপচয় কমানো যায়।
গম চাষের অর্থনৈতিক দিক
গম চাষ একটি লাভজনক কৃষি ব্যবসা হতে পারে, যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা করা যায়। গমের উৎপাদন খরচ, বাজার চাহিদা, এবং স্থানীয় মূল্য বিবেচনা করে চাষাবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে। বর্তমানে, সরকার গম চাষে কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করে থাকে, যেমন - বীজ, সার, এবং কীটনাশকের উপর ভর্তুকি।
আরও জানার জন্য
- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
- উইকিপিডিয়া:গম
- সার প্রয়োগের নিয়মাবলী
- রোগ ও পোকা ব্যবস্থাপনা
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
- মাটি পরীক্ষা পদ্ধতি
- বীজ শোধন প্রক্রিয়া
- সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
- শস্য পর্যায়
- জৈব সার
- ড্রিপ ইরিগেশন
- স্প্রিংকলার সেচ
- লেজার ল্যান্ড লেভেলিং
- গম প্রক্রিয়াকরণ
- গম বাজারজাতকরণ
- গম আমদানি ও রপ্তানি
- খাদ্য নিরাপত্তা
- পুষ্টিগুণ
- কৃষি অর্থনীতি
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
