এমিল ডুরখেইম
এমিল ডুরখেইম
এমিল ডুরখেইম (১৮৫8-১৯১৭) ছিলেন একজন প্রভাবশালী ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী। তাঁকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি সমাজকে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে দেখেন এবং সামাজিক ঘটনাগুলির কারণ অনুসন্ধানে মনস্তত্ত্বের পরিবর্তে সামাজিক কাঠামোর ওপর জোর দেন। ডুরখেইমের কাজ সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতিগত ভিত্তি স্থাপন করে এবং বিষয়টিকে একটি স্বতন্ত্র একাডেমিক শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে।
জীবনী
এমিল ডুরখেইম ১৮৫৮ সালের ১৫ এপ্রিল ফ্রান্সের এপিনালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষক। ডুরখেইম প্রথমে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি প্যারিসের École Normale Supérieure-এ দর্শন ও সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। ১৮৮২ সালে তিনি দর্শনশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন এবং এরপর বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন লাইসিয়াম-এ শিক্ষকতা করেন। ১৮৯০ সালে তিনি বোর্দো বিশ্ববিদ্যালয়-এ সমাজবিজ্ঞানের প্রথম অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়-এ অধ্যাপনা করেন। ১৯১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয়।
সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি
ডুরখেইম সমাজবিজ্ঞানকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন এবং এর জন্য তিনি একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। তাঁর মতে, সমাজতত্ত্বের মূল বিষয় হলো ‘সামাজিক ঘটনা’ (Social facts)। সামাজিক ঘটনা হলো এমন সব আচরণ, চিন্তা ও অনুভূতি যা ব্যক্তির বাইরে বিদ্যমান এবং যা ব্যক্তির ওপর বাহ্যিক চাপ সৃষ্টি করে। এই ঘটনাগুলি ব্যক্তিগত ইচ্ছার ফল নয়, বরং সামাজিক কাঠামোর দ্বারা নির্ধারিত।
ডুরখেইমের পদ্ধতি মূলত তিনটি ধাপে বিভক্ত:
১. বিষয়বস্তু নির্বাচন: প্রথমে, সমাজবিজ্ঞানীকে এমন একটি সামাজিক ঘটনা নির্বাচন করতে হবে যা গবেষণার জন্য উপযুক্ত। ২. তথ্যের সংগ্রহ: এরপর, ঘটনাটি সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। ডুরখেইম গুণগত (qualitative) এবং পরিমাণগত (quantitative) উভয় ধরনের তথ্য সংগ্রহের ওপর জোর দেন। ৩. কারণ অনুসন্ধান: সবশেষে, সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘটনাটির কারণ নির্ণয় করতে হবে। ডুরখেইম মনে করতেন, সামাজিক ঘটনার কারণ অন্য সামাজিক ঘটনাতেই নিহিত থাকে।
ডুরখেইম সামাজিক ঘটনাগুলিকে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেছেন:
- নৈতিকতা (Morality): সমাজের নিয়ম-কানুন ও মূল্যবোধ।
- আইন (Law): সমাজের আনুষ্ঠানিক বিধি-নিষেধ।
- সাধারণ অভ্যাস (Common customs): সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথা।
গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ও ধারণা
ডুরখেইমের সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বগুলি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ও ধারণা নিচে আলোচনা করা হলো:
- সামাজিক সংহতি (Social Solidarity): ডুরখেইম সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য সামাজিক সংহতির ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তিনি সামাজিক সংহতিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন:
* যান্ত্রিক সংহতি (Mechanical Solidarity): এটি ঐতিহ্যবাহী সমাজে দেখা যায়, যেখানে ব্যক্তিরা তাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতার মিলের কারণে একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ থাকে। এখানে ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে পার্থক্য কম থাকে। * জৈব সংহতি (Organic Solidarity): এটি আধুনিক সমাজে দেখা যায়, যেখানে ব্যক্তিরা তাদের কাজের বিভাজন ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে একে অপরের সাথে আবদ্ধ থাকে। এখানে ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে পার্থক্য বেশি থাকে।
- অ্যানোমি (Anomie): ডুরখেইম অ্যানোমিকে একটি সামাজিক অবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, যেখানে সমাজের নিয়ম-কানুন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ব্যক্তিরা দিশেহারা বোধ করে। এটি সাধারণত দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনের সময় দেখা যায়। আತ್ಮহত্যা নিয়ে তাঁর গবেষণা এই ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
- ধর্মের সামাজিক ভূমিকা (Social Role of Religion): ডুরখেইম ধর্মকে সামাজিক সংহতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, ধর্ম সমাজকে একটি সাধারণ বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে। তিনি ‘টটেমিজম’ (Totemism) নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে কীভাবে আদিম সমাজে ধর্ম সামাজিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
- শিক্ষার ভূমিকা (Role of Education): ডুরখেইম শিক্ষা ব্যবস্থাকে সামাজিকীকরণ (Socialization) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেন। শিক্ষা শিশুদের সমাজের নিয়ম-কানুন, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করে তোলে এবং তাদের সামাজিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করে।
উল্লেখযোগ্য রচনা
ডুরখেইমের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা রয়েছে, যা সমাজবিজ্ঞানকে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- দ্য ডিভিশন অফ লেবার ইন সোসাইটি (The Division of Labour in Society) (১৮৯৩): এই গ্রন্থে তিনি আধুনিক সমাজের শ্রম বিভাজন এবং এর ফলে সামাজিক সংহতির পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
- দ্য রুলস অফ সোসিওলজিক্যাল মেথড (The Rules of Sociological Method) (১৮৯৫): এটি সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি নিয়ে তাঁর সবচেয়ে প্রভাবশালী কাজ। এখানে তিনি সমাজতত্ত্বের বিষয়বস্তু, পদ্ধতি এবং লক্ষ্যের রূপরেখা দিয়েছেন।
- সুসাইড (Suicide) (১৮৯৭): এই গ্রন্থে তিনি আত্মহত্যার সামাজিক কারণগুলি অনুসন্ধান করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে কীভাবে সামাজিক সংহতির অভাব আত্মহত্যার হার বাড়িয়ে দিতে পারে।
- দ্য এলিমেন্টারি ফর্মস অফ রিলিজিয়াস লাইফ (The Elementary Forms of Religious Life) (১৯১২): এই গ্রন্থে তিনি ধর্মের উৎপত্তি ও সামাজিক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এর সাথে সংযোগ
যদিও এমিল ডুরখেইমের কাজ সরাসরি বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এর সাথে সম্পর্কিত নয়, তবে তাঁর সমাজতাত্ত্বিক ধারণাগুলি বাজারের আচরণ এবং বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে সহায়ক হতে পারে।
১. সামাজিক প্রবণতা (Social Trends): ডুরখেইমের তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের আচরণ সামাজিক নিয়ম ও প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হয়। বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এর ক্ষেত্রে, বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তগুলি প্রায়শই বাজারের সামগ্রিক প্রবণতা এবং অন্যদের অনুসারী হওয়ার প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
২. অ্যানোমি ও ঝুঁকি গ্রহণ (Anomie and Risk Taking): যখন বাজারে অস্থিরতা দেখা যায় এবং নিয়ম-কানুন দুর্বল হয়ে পড়ে (অ্যানোমি), তখন বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত হতে পারে।
৩. মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক প্রভাব (Psychology and Social Influence): ডুরখেইমের কাজ সামাজিক প্রভাবের গুরুত্ব তুলে ধরে। বাইনারি অপশন ট্রেডিং-এ, সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের মতামত বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।
৪. বাজারের সংহতি (Market Solidarity): বাজারের একটি নির্দিষ্ট অংশে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংহতি তৈরি হতে পারে, যা বাজারের গতিবিধিকে প্রভাবিত করে।
এই সংযোগগুলি সম্পূর্ণরূপে তাত্ত্বিক হলেও, ডুরখেইমের ধারণাগুলি বিনিয়োগকারীদের আচরণ এবং বাজারের গতিশীলতা বুঝতে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ দিতে পারে।
| ক্ষেত্র | প্রভাব | সমাজবিজ্ঞান | আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন | অপরাধবিজ্ঞান | অপরাধের সামাজিক কারণ অনুসন্ধান | শিক্ষা | শিক্ষার সামাজিক ভূমিকা ব্যাখ্যা | ধর্মীয় অধ্যয়ন | ধর্মের সামাজিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ | অর্থনীতি | বাজারের আচরণ ও বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব বোঝা |
সমালোচনা
ডুরখেইমের কাজের কিছু সমালোচনাও রয়েছে। কেউ কেউ তাঁর পদ্ধতির সরলতা এবং সামাজিক ঘটনাগুলিকে অতিরিক্তভাবে কাঠামোগত হিসেবে দেখার প্রবণতার সমালোচনা করেছেন। আবার অনেকে মনে করেন যে তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি। তা সত্ত্বেও, এমিল ডুরখেইমের অবদান সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
উপসংহার
এমিল ডুরখেইম ছিলেন একজন প্রভাবশালী সমাজবিজ্ঞানী, যিনি সমাজকে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং সামাজিক ঘটনাগুলির কারণ অনুসন্ধানে সামাজিক কাঠামোর ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর তত্ত্ব ও ধারণাগুলি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং আজও প্রাসঙ্গিক। সামাজিক কাঠামো, সামাজিক নিয়ম, সামাজিক পরিবর্তন এবং মানবিক আচরণ বোঝার জন্য ডুরখেইমের কাজ অপরিহার্য।
আরও দেখুন
- সমাজবিজ্ঞান
- ফরাসি সমাজবিজ্ঞান
- কার্ল মার্ক্স
- ম্যাক্স ওয়েবার
- আর্নেস্ট বার্ক
- তালকোট পার্সনস
- রবার্ট কি Merton
- সামাজিক সংহতি
- অ্যানোমি
- টটেমিজম
- সামাজিকীকরণ
- আত্মহত্যা
- বাইনারি অপশন ট্রেডিং
- টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ
- ভলিউম বিশ্লেষণ
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
- বাজারের প্রবণতা
- বিনিয়োগের মনস্তত্ত্ব
- ফিনান্সিয়াল মার্কেট
- অর্থনৈতিক সমাজবিজ্ঞান
এখনই ট্রেডিং শুরু করুন
IQ Option-এ নিবন্ধন করুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $10) Pocket Option-এ অ্যাকাউন্ট খুলুন (সর্বনিম্ন ডিপোজিট $5)
আমাদের সম্প্রদায়ে যোগ দিন
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যোগ দিন @strategybin এবং পান: ✓ দৈনিক ট্রেডিং সংকেত ✓ একচেটিয়া কৌশলগত বিশ্লেষণ ✓ বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি ✓ নতুনদের জন্য শিক্ষামূলক উপকরণ
